কচু বেচে আয় ৫০ হাজার টাকা
ইসলামিয়া কৃষি প্রজেক্ট
সরকারি চাকরির পাশাপাশি প্রায় ১৬ বিঘা জমিতে দেশি-বিদেশি বাহারি জাতের কচুর চাষাবাদ করেছেন মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার আলমগীর হোসেন আলম নামের এক ব্যক্তি। অনুকূল আবহাওয়া আর উত্তম পরিচর্যায় কচু চাষাবাদ করে সফলতার দুয়ারে স্বপ্ন বুননে ব্যস্ত আলমসহ একাধিক কচুচাষি।
চলতি মৌসুমে সিংগাইর উপজেলার চারিগ্রাম ইউনিয়নের দাশেরহাটি এলাকার প্রায় ১৯ বিঘা জমিতে কচুসহ বাহারি রকমের সবজির আবাদ করেছেন আলম। যার মধ্যে প্রায় ১৬ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন বিভিন্ন জাতের কচুর। দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে কচু ও কচুর লতি রফতানির স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
অল্প খরচে অধিক মুনাফা হওয়ায় কচু চাষাবাদে ব্যস্ত রয়েছেন একই এলাকার একাধিক কৃষক। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যাচ্ছে সিংগাইর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চাষাবাদ হওয়া এসব কচু ও কচুর লতি। অন্যান্য সবজির তুলনায় কচু চাষাবাদে কোনো ঝুঁকি না থাকায় কচু চাষে চাষাবাদে আগ্রহী স্থানীয় কৃষকেরা।
সরেজমিনে আলমগীর হোসেন আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘ইসলামিয়া কৃষি প্রজেক্ট’ ঘুরে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের কচু চাষাবাদের চিত্র দেখা যায়। থাইল্যান্ডের ফেমাস থাই কচু, আলমের মুতা কচু, পানি কচু ও লতিরাজ কাঠকচুর চাষাবাদে ব্যস্ত আছেন একাধিক শ্রমিক।
বিজ্ঞাপন
এসব কচুর চাষাবাদ ছাড়াও একই প্রকল্পের বিভিন্ন জমিতে পেঁপে, ফুলকপি, মিষ্টিকুমড়া, মুলাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির আবাদ করেছেন তিনি। যেখানে নিয়মিতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন চার-পাঁচজন শ্রমিক। তবে কাজের ব্যস্ততা বাড়লে শ্রমিকের সংখ্যাও বাড়ে ইসলামিয়া কৃষি প্রজেক্টে।
আলমসহ একাধিক কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এক বিঘা জমিতে কচু চাষাবাদের জন্য জমি তৈরি থেকে শুরু করে সবশেষ পর্যন্ত ব্যয় হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে তিন হাজার কচুর গাছ বুনন করা যায়। এসব গাছ থেকে লতিও বিক্রি করা যায়। সব মিলিয়ে এক বিঘা জমি থেকে কচু ও লতি মিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ টাকার ফলন বিক্রি করা যায় অনায়াসে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামিয়া কৃষি প্রজেক্টের পরিচালক আলমগীর হোসেন আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় ১৬ বিঘা জমিতে কচুর চাষাবাদ করেছেন তিনি। এসব জমিতে চারটি জাতে কচুর চারা রোপণ করা হয়েছে। এর মধ্যে থাইল্যান্ডর উন্নত জাতের আলম ফেমাস থাই কচু, আলমের মুতা বা কান্ড কচু, পানি কচু এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণার লতিরাজ কাট কচু।
কচুচাষি আলম বলেন, একবিঘা জমিতে থাইল্যান্ডের আলমের ফেমাস কচু ও আলমের মুতা কচুর তিন হাজার চারা এবং লতিরাজ কাট কচুর চারা লাগানো যায় চার হাজার। এই একবিঘা জমিতে মোট খরচ হয় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। আর আট থেকে দশ মাস উত্তম পরিচর্যা আর দরদাম ভালো পেলে লতি, কাণ্ড, মুতাগুলো স্থানীয় ও পাইকার বাজারে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা বিক্রি করা যায়।
আলমের প্রজেক্টে নিয়মিত কাজ করেন পাঁচজন শ্রমিক। কাজের পরিধি বাড়লে শ্রমিকও বাড়ানো হয়। তাতে প্রতিবছর তার প্রজেক্টে মোট খরচ হয় ১০ লাখ টাকা। আর যাবতীয় খরচ বাদে প্রতিবছর আয় হয় ১৬ লাখ টাকা।
বিভিন্ন ব্যবসা ও পেশা বাদ দিয়ে কৃষিকাজে বিনিয়োগ কেন করেছেন, জানতে চাইলে আলম বলেন, মাটি এমন জিনিস, মাটি থেকে যে যেভাবে আয় করে নিতে পারে। আমাদের বাপ-দাদারা ধান-পাট চাষ করে জমি থেকে ফলন নিতেন। কিন্তু এখন আধুনিকায়ন হয়েছে, ইন্টারনেটের মাধ্যেমে কৃষিকাজের বিভিন্ন ফসল চাষ সম্পর্কে তথ্য জেনে কিছুটা ধারণা নিয়ে চিন্তা করেছি কচুর চাষাবাদ করার। কারণ, কচু রোদবৃষ্টিসহ সবকিছু সহ্য করতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিতে অন্যান্য ফসলের কমবেশি ক্ষতি হয় কিন্তু কচুর তেমন ক্ষতি হয় না। এ জন্য কচুর চাষাবাদ করার পরিকল্পনা করি। এ ছাড়া আমাদের সিংগাইর উপজেলায় আমিই প্রথম এই কচুর আবাদ করছি। মূলত কৃষিকাজের প্রতি আগ্রহ থেকেই এই পেশা আসা হয়েছে।
কৃষিকাজের অন্যান্য ফসল আবাদ না করে কচুর আবাদ করার বিষয়ে তিনি বলেন, অন্যান্য ফসলে ঝুঁকি থাকে কিন্তু কচুতে তেমন ঝুঁকি নেই আর অল্প পুঁজিতে অধিক লাভবান হওয়া যায়। আমি কচু চাষে লাভবান হয়েছি দেখে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকরা এখন কচু চাষে উৎসাহিত হচ্ছেন।
কচু চাষাবাদ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, জানতে চাইলে আলম বলেন, চলতি বছরে দুই লাখ কচুর চারা বিক্রি করছেন। দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে আরও দুই লাখ কচুর চারা বিক্রি করবেন। কচুর লতি ও কচুর মুতা/কাঠ/কাণ্ড চাষাবাদে দেশ ও দেশের বাইরে প্রসার করা। এ ছাড়া দেশের চাহিদা মিটিয়ে জর্ডান ও ইতালিতে কচু রফতানির বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে বলেও জানান আলম।
একই প্রজেক্টে কর্মরত শ্রমিক বারাক আলী বলেন, এই সিংগাইর থানায় ১৭ থেকে ১৮ বছর ধরে কৃষিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তিনি। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলায়। ইসলামিয়া কৃষি প্রজেক্টে তিন বছর ধরে কাজ করেন। প্রতি মাসে কাজের মজুরি হিসেবে পান ১৩ হাজার টাকা। তাতে পরিবার নিয়ে অনেক সুখে রয়েছেন বলে জানান এই শ্রমিক।
আলমের কচু চাষাবাদে আগ্রহী হয়ে চারিগ্রাম এলাকার ইউসুবুর রহমান নামের কৃষক বলেন, দুই বিঘা জমিতে কচুর সঙ্গে ফুলকপির মিশ্র চাষাবাদ করেছেন তিনি। কচু চাষাবাদ মূল উদ্দেশ্য হলো আমি আলম ভাইয়ের একটা ভিডিওতে দেখছিলাম, তখন থেকেই আমার ইচ্ছা কচুখেত করার। এবার কচুর আবাদ করে সফল হতে পারলে ভবিষ্যতে আরও বড় করে কচুখেত করার চিন্তাভাবনা আছে বলে মন্তব্য করেন এই তরুণ কচুচাষি।
একই গ্রামের আরেক কৃষক আবদুল আলিম বলেন, তিনিও দুই বিঘা জমিতে কচু আবাদ করেছেন। পাশাপাশি ফুলকপিও রোপণ করেছেন। কচু চাষে আগ্রহী কেন জানতে চাইলে আলিম বলেন, কয়েক বছর ধরে দেখছি আলম ভাই কচু চাষাবাদ করে বেশ মুনাফা পাচ্ছেন। তার দেখাদেখি আমিও এবার কচুর চাষ শুরু করেছি। তবে এ বছর কচু চাষে লাভবান হলে সামনের বছর আরও বেশি জমিতে কচুর আবাদ করবেন বলে জানান কৃষক আবদুল আলিম।
মানিকগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. শাহ্জাহান আলী বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে জানান, ইতিমধ্যে সিংগাইর উপজেলার দাশেরহাটি গ্রামের ইসলামিয়া কৃষি প্রজেক্ট সরেজমিনে পরিদর্শন করা হয়েছে। কচু চাষাবাদ করে ওই গ্রামের চাষি আলমগীর হোসেন আলম বেশ লাভবান হচ্ছেন। স্বল্প খরচে অধিক মুনাফা পাওয়া যায় বলে কচু চাষাবাদে আগ্রহী ওই এলাকার কৃষকরা।
কৃষি অফিস থেকে কচু আবাদের ক্ষেত্রে কৃষকদের সব সময় বিভিন্ন রকম পরামর্শ এবং কচু চাষাবাদে আগ্রহী কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। এক বিঘা জমিতে কচু আবাদ করতে খরচ হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা আর কচু বিক্রি করে আয় হয় খরচ বাদে প্রায় দুই লাখ টাকা। এ ছাড়া ইসলামিয়া কৃষি প্রজেক্টের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে উৎপাদিত এসব কচু বিদেশে রফতানি করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলে জানান এই উপপরিচালক।
এনএ