মায়ের মুখ দিয়া যা হিকছি হেইডাই আপন ভাষা
মায়ের মুখ দিয়া যা হিকছি হেইডাই আপন ভাষা। তয় হগোলডির লগে একটা ইজ্জত রাইখ্যা কতা কইতে গ্যালে সচারচার মানষে ‘মান’ ভাষাডারে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু হ্যাতে হে কতা কইয়া শান্তি নাও পাইতে পারে। আম্মে ঘরে যে ভাষায় কতা কন, হেই ভাষা কিন্তু বাইরে-ব্যামালা মানুষজনের সামনে কন না। হ্যারপরও ঘরের ভাষা, যে ভাষা মা’র মুখ দিয়া হেকছেন হেইডাই আম্মের ধারে মজার।
মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা পোস্টের বিশেষ আয়োজন ‘এসো প্রাণের ভাষায় কথা বলি’ লইয়া মোরা বরিশাইল্লা কয়েক শ্রেণিপেশার মানষের লগে কতা কইছি। এ্যার মধ্যে আছে ভাষা গবেষক, জনপ্রিয় অভিনেতা, সাংবাদিক, স্কুল শিক্ষার্থী। হ্যারা কইছে, কোনডা মান ভাষা আর কোনডা আঞ্চলিক এইয়্যার ফারাক কইর্যা কেহরে ছোড হরার উপায় নাই। বিশ্বের হগোল ভাষাই আঞ্চলিক। আর বরিশাইল্লা মানষে জম্মের পর যে ভাষা হেকছে, হেই ভাষায় কতা কইতে চায় মারার আগ পর্যন্ত।
বিজ্ঞাপন
জনপ্রিয় নাটক যমজের অভিনেতা জেসন পলাশ কইছে, বরিশালের ভাষা চয়েস করছি, এটা মোর একলার ব্যাপার না। এডা হগোলডির ব্যাপার। কারণ কী? মনের ভাব প্রকাশ করার লইগ্যা যদি আম্মে মনডারেই না খাডাইতে পারেন তাইলে আপনে মজা পাইবেন কোন জাগায়? যে অঞ্চলে মুই জন্মাইচি হেই অঞ্চলের ভাষা মানে মুই চাইতেছি- মুই বরিশালে জন্মাইছি, মুই এই অঞ্চলের ভাষাডারে কমু। এমনভাবে কমু যেন মুই তৃপ্তি পাই।
হে কইছে, আপনে যদি মোরে কন শুদ্ধ ভাষায় কতা কইতে হইবে মুইতো হ্যা পারমু না। শুদ্ধ ভাষায় কতা কওয়াডা হইছে এক ধরনের চাপ। অনেকেই এই চাপ নিতে পারে না। ধরেন কেউ বরিশালে জন্মাইছে। হে যদি ঢাকা যায় চাকরির জন্য। হ্যারে শুদ্ধ ভাষায় কতা কইতে কইলে হেতো মোর বা আমাকে শব্দডারে কইবে ‘মোকে’। এইডা ঠিক না। তয় মুই মোর জীবনের শ্যাষ পর্যন্ত মা’র মুখ দিয়া যে ভাষা হিকছি, হেই বরিশাইল্লা ভাষা কইতে চাই। মোর ধারে ভাষা মানে ভাষা। এর কোনো শুদ্ধ আর অশুদ্ধ কইতে কিছু নাই।
বিজ্ঞাপন
স্কুলশিক্ষার্থী হেনা আক্তার কয়, মোগোধারে মায়ের ভাষা কইতে বুঝায়- মোরা মায়ের প্যাটদিয়া পড়ার পর যে ভাষা কইতে হিকছি হেইয়্যাই মোগো মাতৃভাষা। মোগো বরিশালের ভাষাই মোগো মাতৃভাষা। মুই যতদিন বরিশালের ভাষায় কতা কইতে পারমু অতদিনই মোরা আনন্দ পামু।
আরেক ছাত্রী স্বপ্না কয়, মোগো স্যারেরা যহন মোগো ক্লাসে পড়ায় তহন মোগো কিন্তু বরিশাইল্লা ভাষায় পড়ায়। পাশাপাশি সাধু ভাষাও ব্যবহার করেন। যদি আঞ্চলিক ভাষা আরো ব্যবহার করা যাইতো হ্যালে মোগো ভাষা সমৃদ্ধ হইতো।
সাংবাদিক মুশফিকুর রহমান কন, মোরা যে ভাষায় কতা কই এইডা হইছে মোগো মায়ের ভাষা। মোগো মায়ও এইভাবে কতা কয়। মাতৃভাষা কইতেতো এইডাই বুঝায়। এইডা মোর আঞ্চল। এই অঞ্চলে মোর জন্ম হইছে। মুইতো এই ভাষায়ই কতা কমু। কোনো শঙ্কা নাই মোর ভাষায় মুই হাঙ্গোদ্যাশে যাইয়া কতা কই। এইডাই পছন্দ করি। এ্যাতে কোনো সমস্যা অয় না বরং গর্ববোধ করি।
সকল ভাষাই আঞ্চলিক
কথা হয় ‘বরিশালের ভাষার অভিধান’ গ্রন্থের প্রণেতা ভাষা গবেষক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মুহসিনের সঙ্গে । বিদগ্ধ এই গবেষক মনে করেন, ভাষার দাবি হচ্ছে মানুষের অভ্যন্তরস্থ ভাবনা, চিন্তা এবং অনুভবকে প্রকাশ করতে পারার সবচেয়ে কার্যকর যোগ্যতা অর্জন করা। আমি দেখেছি বরিশালের ভাষার একটি জোর আছে যা অনুভবকে ধারণ করতে পারে। যে অনুভূতি আমার মাটির সঙ্গে মেশানো যে অনুভূতি শৈশবের সকল চিন্তাভাবনা এবং আনুভবের সঙ্গে মেশানো। অথচ সেই অনুভূতি আমরা যেটিকে বলি মান ভাষা সেটি ধারণ করতে অতখানি সামর্থ্য নয়। এখান থেকেই আমার মনে হলো বরিশালের ভাষাটি সকলের কাছে পৌঁছানো দরকার। আমার অনুভূতি যে ভাষায় রয়েছে সেই ভাষা স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্যই ‘বরিশালের ভাষার অভিধান’ গ্রন্থের কাজটি শুরু করি।
তিনি বলেন, মান ভাষা এবং আঞ্চলিক ভাষা বলে যাকে আমরা সংজ্ঞায়িত করি এই দুটিতে পার্থক্য রয়েছে। যে পার্থক্যের সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। চিন্তার যত অনুসঙ্গ রয়েছে সেগুলো সব ধারনের ক্ষমতা ছেলেবেলায় আমরা যে ভাষার মধ্যে বড় হয়েছি (আঞ্চলিক) সেই ভাষার নেই। কারণ এই ভাষা ওইভাবে পরিপুষ্ট নয়। কিন্তু ছেলেবেলায় যে ভাষায় মানুষ বড় হয় সেই ভাষাটি অনুভবের সঙ্গে মিশ্রিত। এই অনুভব আবার প্রমিত বা মান ভাষা ধারণ করে না। এজন্য দরকার প্রমিত বা চিন্তারাজ্যের ভাষার সঙ্গে যদি আঞ্চলিক বা ছেলেবেলার ভাষার মিশ্রিত করা যায় তাহলে উভয় দিক দিয়েই ভাষার শ্রীবৃদ্ধি হয়।
উদাহরণ দিয়ে ড. মুহাম্মদ মুহসিন বলেন, আধুনিক তুরস্ক যখন ফার্সি বর্ণে তাদের ভাষা লেখা বাদ দিয়ে রোমান হরফে লেখা শুরু করল তখন কিন্তু তারা আঞ্চলিক ভাষা থেকে অনেক শব্দ গ্রহণ করে। বলা চলে আঞ্চলিক ভাষার জোগান দিয়েই তুরস্কের বর্তমান ভাষাটি টিকে আছে। অর্থাৎ আঞ্চলিক ভাষাকে শব্দরাজ্যের উৎস হিসেবে নিলে ভাষার দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি হয়।
তিনি বলেন, বাংলা ভাষার ৪০০ বছরের ইতিহাস বলছে কলোনাইজাররা আমাদের কথ্য ভাষা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়। যখন ক্ষমতাধর হতে ইংরেজি ভাষা গ্রহণকে গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয় তখন মানুষ ইংরেজি চর্চার দিকে অগ্রসর হলো। এরপর এলো বাংলার মান ভাষা বলে শিক্ষিত তথাকথিত ক্ষমতাবান হওয়া। তখন ধীরে ধীরে বাংলার যে জনগণের ভাষা সেটি অনাদ্রিত ও প্রবঞ্চিত হলো। এখান থেকে আমার মাটির ভাষা, মুখের ভাষা অনেক দূরে সরে গেল। সংস্কৃতিহীনতার প্রতীক হয়ে দাঁড়াল। যেটি আমাদের জন্য কলোনিয়াল মানসিকতার প্রকাশ। পৃথিবীর সকল ভাষাই আঞ্চলিক। অঞ্চলভেদেই ভাষার বিভিন্ন রূপ হয়। ফলে ইংরেজি, বাংলা বা অন্যান্য সকল ভাষাই আঞ্চলিক।
মুহাম্মদ মুহসিন মনে করেন, সকল আঞ্চলিক ভাষারই একটি মানরূপ থাকে। তবে সেই মানরূপ পরিপূর্ণভাবে মানুষের অনুভবের প্রকাশ করতে পারে না। যদিও জনগণের ভাষায় সেই অনুভব জড়িয়ে থাকে। এজন্য উভয় ভাষার মিশেল হওয়া খুবই জরুরি।
আরএআর