মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার হাড়াভাঙ্গা গ্রামের পালান মণ্ডলের ছেলে মিন্টু মিয়া। তিনি একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ২০২১ সালে মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য মেহেরপুরের বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অফিসে আসেন তিনি।

সেখানে তার সঙ্গে দেখা হয় স্বাধীন নামে এক ব্যক্তির। স্বাধীন তাকে বলেন, বিআরটিএ অফিসে অনেক বিড়ম্বনা, সহজে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবেন না। 

পরে স্বাধীন নিজেই তাকে দ্রুত লাইসেন্স করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে একটি শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স হাতে ধরিয়ে দেন তিনি। বিনিময়ে নেন ১০ হাজার টাকা। সময়মতো পরীক্ষা ও ফিঙ্গার প্রিন্টও (আঙুলের ছাপ) দেন মিন্টু মিয়া।

এরপর দুই বছর পার হয়েছে, এখনো লাইসেন্স পাননি মিন্টু মিয়া। বিআরটিএ অফিস আর দালাল স্বাধীনের কাছে কেবল ঘুরছেন তিনি। কোনো কাজ হচ্ছে না।

অবশেষে অফিসের তথ্য ঘেঁটে তাকে জানানো হয় এ পর্যন্ত তার যেসব পরীক্ষা ও ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া হয়েছে তার কোনো তথ্য বিআরটিএ অফিসে নেই। দালাল স্বাধীন তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।

এদিকে ব্র্যাকের গাংনী শাখার ফিল্ড অফিসার যশোর শহরের তাইজুল ইসলাম দুই বছর আগে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য দারস্থ হন দালাল স্বাধীনের। মিন্টু মিয়ার মতো একইভাবে তার কাছ থেকেও নেওয়া হয় ১০ হাজার টাকা। কিন্তু গত দুই বছর তার কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিছুই হয়নি। মাঝেমধ্যে অফিসে এলে লার্নার লাইসেন্সে সিল মেরে মেয়াদ বাড়ানো হয়। অফিসিয়ালি কোনো তথ্য আছে কি না তা যাচাইও করা যাচ্ছে না বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের অবহেলায়।

শুধু মিন্টু মিয়া কিংবা তাইজুল ইসলাম নন, তাদের মতো অনেকে দালালদের কাছ থেকে প্রতারিত হয়েছেন। মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েও পাচ্ছেন না ড্রাইভিং লাইসেন্স।

রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) মেহেরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ে বেশ কয়েকজন সেবাগ্রহীতা ঢাকা পোস্টকে এসব ভোগান্তির কথা জানান।

গাংনী উপজেলার ব্রজপুর গ্রামের জয়নাল আবেদীনের ছেলে রাজিব হোসেন জানান, তিনি সিঙ্গাপুর প্রবাসী। তিন মাসের ছুটিতে এসেছেন। মোটরসাইকেল চালাতে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন দুই মাস আগে। তিনি নিজেই অনলাইনে আবেদন করেন। অফিসে এসে লাইসেন্সের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে বিভিন্ন টেবিলে পাঠান কর্মচারীরা।

হতাশ হয়ে অফিসের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন রাজিব। কথা হয় তার সঙ্গে।

তিনি জানান, এখানে শুধু হয়রানি আর হয়রানি। এদিকে তার ছুটি প্রায় শেষ। তার আগে না পেলে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে লাইসেন্স পাওয়া।

মেহেরপুর শহরের আব্দুর রহিম বলেন, ২০১৯ সালে আমি আবেদন করি। ২০২০ সালে পরীক্ষা দিই। পরীক্ষায় পাসও করি। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে অফিস বন্ধ থাকায় ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে অফিসে গেলে জানানো হয় আগের ঠিকাদারের সময়ে আমার ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়া হয়নি। সেসব তথ্য এখন আর পাওয়া যাবে না। নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে তাই আবারো ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে হবে।

গাংনীর হিজলবাড়িয়া গ্রামের নওশাদ আলীর ছেলে শাহাবুদ্দিন বলেন, ২০১৯ সালের একটি লার্নার কাগজ নিয়ে অফিসে ঘুরছি। এখনো লাইসেন্সের কোনো হদিস মিলছে না। দেখা যাক আরও কতদিন ঘুরতে হয়। আজকে আবার অফিসের লোকজন জানালেন সফটওয়্যার নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না, কয়েকদিন পর আবার খোঁজ নিতে বলেন।

গাংনীর জামান বলেন, স্বাধীন নামের একজন অফিসে থাকেন। তিনি ‘এই অফিসের সব’ বলে পরিচয় দেন। তাকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে লাইসেন্স করেছিলাম। আমার লাইসেন্স হওয়ার পর আমার এক আত্মীয়ের কাগজপত্র ও টাকা দিই। কিন্তু এখন স্বাধীনের কোনো হদিস মিলছে না।

শুধু স্বাধীন নয়, গোভিপুরের নজরুল, রাজনগরের শাহিনসহ কয়েকজন এই অফিসের কর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে প্যাকেজ আকারে দায়িত্ব নিয়ে থাকেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

জেলার কুলবাড়িয়া গ্রামের নাজমুল বলেন, ২০১৪ সালে আমি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করি। আবেদনের প্রেক্ষিতে আমাকে পরীক্ষার জন্য ডাকা হলে পরীক্ষা দিই এবং পাস করি। পরে আমাকে ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য ডাকা হয়। ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে গেলে অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ৩০০ টাকা দাবি করেন। আমি সেই টাকা না দিয়ে চলে আসি। পরে আমাকে আর লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। এভাবে অফিসে আমি দুই বছর গিয়েছি আর মেয়াদ বাড়িয়ে এনেছি। পরে অফিসার পরিবর্তন হলে আমি আবারো অফিসে যায়। তিনি আমার তথ্য খুঁজে দেখেন অফিসে কোনো তথ্য নেই। মাত্র ৩০০ টাকা না দেওয়ার কারণে আমাকে দুই বছর শুধু ঘুরতেই হয়নি, নতুন করে আবেদন করতে হয়েছে। পরে নতুনভাবে আবেদন ও টাকা খরচ করে লাইসেন্স নিয়েছি।

মেহেরপুর বিআরটিএ অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), মেহেরপুর জেলায় কার্যক্রম শুরু করে। তখন মাঝেমধ্যে এই অফিসে দু-একজনের নিয়োগ হতো। তার আগে মেহেরপুর জেলার মানুষকে পার্শ্ববর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া গিয়ে মোটরযান ও ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে হতো। পরে জেলাবাসীর দুর্ভোগ লাঘবে ২০১৯ সাল থেকে স্থায়ীভাবে কার্যক্রম চালু হয়। তবে অনেক তথ্য অফিসে সংরক্ষিত নেই।

মেহেরপুর জেলায় পেশাদার ও অপেশাদার লাইসেন্সধারীর সংখ্যা ৬ হাজার ৯০৩টি। এর বিপরীতে মেহেরপুর জেলায় লাইসেন্সকৃত মোটরসাইকেল রয়েছে ৪০ হাজার, ট্রাক ৪০টি, বাস ৩৭টি, কাভার্ডভ্যান ২৭টি ও লেগুনা রয়েছে ৭০টি। তৎকালীন সময়ে ‘টাইগ্রার আইটি বাংলাদেশ’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজের দায়িত্ব পায়। পরে ওই প্রতিষ্ঠান কোনো লোক নিয়োগ না দেওয়ার কারণে ঠিকাদারদের কাজও করতে হতো বিআরটিএ অফিসের স্টাফদের। এতে অনেক ভোগান্তি হতো। পরে ওই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সময়কাল শেষ হওয়ার পর বর্তমানে নিয়োগ পেয়েছে ‘মাদ্রাজ সিকিউরিটি বিল্ডার্স’। এ প্রতিষ্ঠানটিতে এনামুল হক নামের একজন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কাজ করছেন।

তিনি জানান, টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠান ডাটা এন্ট্রির কাজ করে। তাদের সময় সারা দেশে ১৩ লাখ ৪৫ হাজার আবেদনকারীর তথ্য মিসিং হয়। এর মধ্যে মেহেরপুরেরও হাজারখানেক রয়েছে। আমরা কাজ পাওয়ার পর আগের লোকজন এলে আমাদের সমস্যা হলেও জনস্বার্থে তাদের কাজও করে দিচ্ছি।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেডের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সেতু বলেন, আমরা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে কাজ করেছি। এখন এই অফিসে রেজিস্ট্রেশন বিভাগে আছি।

ডাটা এন্ট্রি মিস হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, আমাদের এখান থেকে সমস্ত তথ্য দিয়ে প্রিন্টিং-এর জন্য ঢাকা পাঠাতে হয়। নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে একটু ঝামেলা হয়েছিল। তবে ধীরে ধীরে সেগুলো নতুন করে ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে সম্পন্ন করা হচ্ছে।

মেহেরপুর বিআরটিএ অফিসের রেজিস্ট্রেশন পরিদর্শক মো. জিয়াউর রহমান বলেন, মেহেরপুর অফিস শুরু থেকে এ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক দিয়ে চলছে। একজন সহকারী পরিচালক চুয়াডাঙ্গায় নিয়োগ পেয়েছেন। সপ্তাহে একদিন (মঙ্গলবার) মেহেরপুরে অফিস করেন। তাছাড়া অফিস সহকারীর পদও শূন্য রয়েছে। ফলে মেহেরপুরের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সেবা দেওয়া খুবই কষ্টের। এখানে স্থায়ীভাবে কর্মকর্তা নিয়োগ হলে আশা করি দুর্ভোগ থাকবে না।

দালালদের দৌরাত্ম্য নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অফিসে কোনো দালাল নেই। অফিসের বাইরে কী হয় তা আমরা বলতে পারব না।

মেহেরপুর বিআরটিএ সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) সৈয়দ আইনুল হুদা চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের অফিসে কোনো দালাল নেই। বাইরে কী হয় তা বলতে পারব না। কেউ যদি দালালদের দ্বারা প্রতারিত হন আমাদের কিছু করার নেই। তাছাড়া আমি মেহেরপুরে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে আছি। সপ্তাহে একদিন (মঙ্গলবার) অফিস করি।

লাইসেন্স প্রত্যাশীদের হয়রানির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।

এমজেইউ