ঘড়ির কাঁটা ঠিক ৯টা। তখনও বন্ধ নাটোরের বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অফিস। বাইরে সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের উপচে পড়া ভিড়। ৯টা ১০ মিনিটে এলেন এক কর্মচারী। তিনি তালা খুলে রুমে প্রবেশ করে তার দাপ্তরিক কাজ শুরু করলেন। তবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেও সহকারী পরিচালকের দেখা পাওয়া যায়নি। কর্মচারীরা জানালেন তিনি ঢাকায় মিটিংয়ে আছেন।

গত রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে দেখা যায়, বেশিরভাগ সেবাগ্রহীতা বাইরে থেকে কাগজপত্র জমা দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ভেতরে প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছেন। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সেবা নিতে আসা অধিকাংশ লোকজন। তবে দালালের শরণাপন্ন হলে সহজেই হয়ে যায় ভোগান্তির উপশম। আর এজন্য গুনতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এছাড়া ঘুষ দিলেই পাস করা যায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা; দক্ষতা প্রমাণের দরকার হয় না। এমনকি ঘুষ দিলে ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়া যায় ফিটনেসবিহীন গাড়িরও!

কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, যে যার মতো ফাইলপত্র ও বিভিন্ন কাগজপত্রে সিল মারায় ব্যস্ত। ভাবসাবে তাদেরকে কর্মকর্তা মনে হলেও আসল পরিচয় হচ্ছে ওরা দালাল। বাস্তবে এসব দালালরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন নাটোরের বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অফিস। দালাল দিয়ে কাজ করতে হয় এটাই যেন নিয়ম বলে মেনে নিয়েছেন গ্রাহকরা।

দালালরা মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সেই জাল ভেদ করে অনেকেই অফিসের মূল কর্মকর্তার কাছে ভিড়তে পারেন না। এতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন হাজার হাজার গ্রাহক। বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে তাদের। এতে সরকার নয়, লাভবান হচ্ছেন দালালরা।

বাগাতিপাড়া উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রাম থেকে আসা মো. আরিফ (২৪) ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্স করার জন্য ৬ মাস আগে এক দালালকে কাগজপত্রসহ সাড়ে ৭ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। তবে এখনো কাজ হয়নি। আজ অফিসে এলে জানানো হয় আরও ৩ মাস লাগবে। এ পর্যন্ত ৬ থেকে ৭ বার অফিসে এলাম। আর কতবার যে আসতে হবে কে জানে!

তিনি আরও বলেন, দালাল ছাড়া এখানে কোনো কাজ হয় না। দালাল না ধরলে ভালো পরীক্ষা দিলেও পাস করা যায় না। আর দালাল ধরলে কোনোরকম পরীক্ষা দিলেই পাস।

মুনির হোসেন নামে এক সেবাগ্রহীতা জানান, গাড়ির ফিটনেস লাইসেন্স এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে এলে পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হয়। দালাল না ধরলে কোনো কাজই হয় না। লাইসেন্স প্রতি দুই থেকে তিনগুণ বেশি টাকা গুনতে হয়।

গুরুদাসপুর থেকে আসা শফিকুল ইসলাম বলেন, কার্ড নবায়নের জন্য ৬ মাস আগে কাগজপত্র জমা দিয়েছি। আজ কার্ড হাতে পেলাম। এ পর্যন্ত আমার প্রায় ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তবে আমি নিজেই কাগজপত্র জমা দিয়েছিলাম।

মালেক হোসেন নামে এক গাড়ির মালিক জানান, তিনি দালালকে দিয়েই কাজ করাচ্ছেন। কারণ, এখানে কেউ সহযোগিতা করেন না। তার অভিজ্ঞতা, দালাল ধরলেই কাজ আগে হবে। দালালদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। দালালরা কর্মকর্তাদের নিয়মিত টাকা দিয়ে সম্পর্ক রাখেন, যাতে তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে যায়।

তিনি আরও জানান, অনেক কর্মকর্তা আছেন, যারা সাধারণ গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেন না, কাজও করে দেন না। নানা অজুহাতে কাজ নিয়ে টালবাহানা করে থাকেন। কিন্তু দালালের কাছে দিলে ঠিকই কাজ করে দেন। তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না, ওই কর্মকর্তা টাকার জন্যই এসব করেছেন।

বনপাড়া থেকে আসা ওহেদুল ইসলাম বলেন, দালাল ছাড়া এখন আর কোনো কাজ হয় না। দেড় মাস আগে আবেদন করেছিলাম। অফিস থেকে তখন বলেছিল ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়ার পর ৩ মাস সময় লাগবে। সেসময় দালালের মাধ্যমে ৭ হাজার টাকা দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, বিআরটিএ এমন একটি জায়গা যেখানে দালাল না ধরলে পরীক্ষায় পাস করা সম্ভব না। একা গেলে যত ভালোই পরীক্ষা দেন না কেন পাস করা প্রায় অসম্ভব। তাই কোনো না কোনো মাধ্যম ধরতেই হবে।

গুরুদাসপুর থেকে আসা রায়হান আলী বলেন, ২০১৯ সালে আবেদন করেছি, কিন্তু এখনো স্মার্ট কার্ড পাইনি। ঘুরতে ঘুরতে ৪ বছর কেটে গেল। আজ আবার এসেছি, দেখি কি হয়।

দত্তপাড়া থেকে আসা ট্রাকচালক আব্বাস আলী বলেন, ৩ বছর আগে আবেদন করেছিলাম কিন্তু এখনো কার্ড পায়নি। নিজেই আবেদন করেছিলাম। পরীক্ষায়ও পাস করেছি। তবে এখনো কেন পাচ্ছি না জানি না।

ঠাকুর লক্ষীকোল থেকে আসা বাবলু হোসেন বলেন, ২০১৯ সালে পরীক্ষা দিয়েছি। কিন্তু করোনার কারণে তখন ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া বন্ধ ছিল। আবার ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়া চালু হয়েছে। সদরে ডোপ টেস্ট করলাম। আমি নিজেই আবেদন করেছিলাম।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, দালাল না ধরলে লাইসেন্স পেতে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ভোগান্তি পোহাতে হয়। অন্যদিকে গাড়ির লাইসেন্স না থাকলে জরিমানা গুনতে হয়। তাই দ্রুত লাইসেন্স পেতে দালাল না ধরে উপায় থাকে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দালাল বলেন, পরীক্ষা দেবেন। সাদা খাতা জমা দিয়ে আসবেন। পাস করানোর দায়িত্ব আমাদের।

এসব বিষয়ে জানতে নাটোর বিআরটিএ মোটরযান পরিদর্শক পরিফুল ইসলামকে অফিসে না পেয়ে তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এদিকে নাটোর বিআরটিএ অফিসের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল খালেক ঢাকায় অবস্থান করছেন বলে জানান অফিসের কর্মচারীরা। তাই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে একাধিকবার কল দিলেও তার মুঠোফোনটি ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

এমজেইউ