আনোয়ার হোসেনের বয়স এখন ৬৭ এর কাছাকাছি। এর মধ্যে ৪০ বছর তার কেটে গেছে কাঁধে করে বুট, বাদাম, শুটকিসহ বিভিন্ন রকমের শিশু খাবার বিক্রি করতে। তিনি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার আড্ডা ইউনিয়নের আড্ডা পাটোয়ারি বাড়ির মৃত আব্দুল লতিফের ছেলে।

৭ সন্তানের জনক আনোয়ারের সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় ঢাকা পোস্টের। এসময় দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের কথা তুলে ধরেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আনোয়ার ১৬-১৭ বছরের তরুণ। ৪ ভাই ১ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। প্রচণ্ড অভাব-অনটনের সংসারে বাবার খুব কষ্ট হতো দেখে বাবার সঙ্গে হালচাষ শুরু করেন মানুষের জমিতে। প্রতি জমিতে ৪ আনা করে আয় হতো। তা দিয়ে সংসার চলত আনোয়ারদের। 

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চারদিকে দুর্ভিক্ষ। ভাতের অভাবে মানুষ যখন জীবন বাঁচাতে হিমশিম খাচ্ছিল। আনোয়ার তখন বাবার সঙ্গে কুমিল্লা সদর উপজেলার শাহপুর এলাকায় চলে যান। সেখানে গিয়ে মানুষের জমিতে কাজ করা শুরু করেন। যা আয় হতো তাই দিয়ে পরিবারের সংসার চলতো।

আবেগাপ্লুত কণ্ঠে আনোয়ার চরম এক বাস্তবতা তুলে ধরতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। বলেন, আমার মা ভাতের অভাবে মারা গেছে। ঠিকমতো খাবার পেত না। আয় রোজগার যা হতো, তাতে ৭ জনের পরিবারে কিছুই হতো না। চারদিকে দুর্ভিক্ষ। কাজে থাকা অবস্থায় খবর আসে দুর্ভিক্ষে মা মারা গেছেন। খবর শুনে তিনদিন পায়ে হেঁটে শাহপুর থেকে আসেন নিজের গ্রামের বাড়িতে। এসে দেখেন মায়ের দাফন শেষ হয়ে গেছে বলে কেঁদে ওঠলেন আবারও। মায়ের মৃত্যুর পর আর শাহপুর যাওয়া হয়নি। এলাকাতেই থেকে যান আনোয়ার। এলাকায় তেমন কাজকর্ম না থাকায় বেকার ঘুরছিলেন। সময়টা তখন ৮০ এর দশক। আনোয়ার সামনে যা পাচ্ছিলেন সেটা করেই ভাইবোনদের মুখে আহার তুলে দিয়েছিলেন। সেসময় আড্ডা এলাকার তার দূর সম্পর্কের এক চাচা আনোয়ারকে বললেন, তুই এভাবে না ঘুরে ব্যবসা-বাণিজ্য কিছু একটা কর, আমি কিছু টাকা দেব। সেই চাচার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে এবং চাচার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বরুড়া বাজারে গিয়ে কিছু শুটকি, বুট, বাদাম আর দাঁড়িপাল্লা, বাটখারা কেনেন। এরপর বাড়িতে এসে বাঁশের তৈরি দুটো কোরা (আঞ্চলিক ভাষায় খারি) রশি দিয়ে কাঁধে ঝুলানোর বিশেষ একটি লাঠি (কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় তাকে ভার বলে) তৈরি করলেন। তারপর নেমে পড়েন ব্যবসায়। 

আনোয়ার বলেন, কাঁধে সেই পণ্যগুলো নিয়ে আড্ডা ইউনিয়নের ১৯টি গ্রাম, আদ্রা ইউনিয়নের ৩-৪টি গ্রাম, ঝলম ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামসহ প্রায় ৩০টির মতো গ্রামে পায়ে হেঁটে পণ্য বিক্রি শুরু করেন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৫-৬ কিলোমিটার হেঁটে পণ্যগুলো ফেরি করেন। সেই যাত্রাটা আজও থামেনি তার। গ্রামগুলোকে আলাদা আলাদা ভাগ করে সপ্তাহে ৬ দিন ময়ালে (পায়ে হেঁটে ফেরি) যেতেন। 

ব্যবসা থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে কোনোরকমে টানাপোড়েনের জীবন চলছিল আনোয়ারের। বর্তমানে আনোয়ার ৪ মেয়ে আর ৩ ছেলে সন্তানের জনক। ৭ সন্তান, স্ত্রী আর নিজে মিলে মোট ৯ সদস্যের ভরণপোষণ চলে আনোয়ারের এই ফেরি করা আয় দিয়ে। 

আগে ব্যবসা কিছুটা ভালো চললেও এখন ভাটা চলছে। জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে ব্যবসার আয় রোজগারের হিসাব মেলাতে পারছেন না তিনি। ৪ মেয়ের মধ্যে ৩ জনের বিয়ে দিয়েছেন, ছোট্ট মেয়েটা অবিবাহিতা। আড্ডা ডিগ্রি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ে। ছেলেদের মধ্যে বড় দুটো ছেলে সিএনজি চালক। ছোট ছেলেটা বেকার। তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য বার বার চেষ্টা করেও পারেননি। বিভিন্ন সময় সুদে টাকা তুলে মেয়ে তিনটিকে বিয়ে দিয়েছেন। সেই সুদ চালাতে চালাতে খুঁইয়েছেন অনেকটা সম্পত্তি। এখনও ২ লাখ টাকা ঋণে আছেন আনোয়ার। মাথায় ছোট মেয়ের বিয়ে দেওয়ার দুশ্চিন্তা। ঘরে স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম স্ট্রোক করে পড়ে আছেন। সবমিলিয়ে সময়টা খুবই খারাপ যাচ্ছে আনোয়ারের। বয়স্ক ভাতার জন্য ইউনিয়ন পরিষদে গেলে সেখান থেকে জানানো হয় বয়স হয়নি। সরকারি সুবিধা শুধু ১০ টাকা চালের একটা কার্ড রয়েছে আনোয়ারের। 

অশ্রুসিক্ত চোখে আনোয়ার বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে পার্শ্ববর্তী মনোহরপুর গ্রামের নুরু হাজির (শিল্পপতি হাজী নুরুল ইসলাম) কাছে কয়কেটা টিনের জন্য যায় আমার স্ত্রী। বেশ কয়েকবার যাওয়ার পরও একটা টিনও পাওয়া যায়নি।

আনোয়ার বলেন, আল্লায় যারে চায় তার আর কেউ লাগেনি। আল্লার ওপরে ভরসা করি হত্তিদিন বার অই। আল্লায় যা মিলায় খাই। অন চইলতে খুব কষ্ট অয়। জিনিসপত্রের যা দাম। তবে খুব কষ্টে চললেও সৎ পথে আয় করার আনন্দ আছে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন তিনি।

আগের মতো শরীরটা চলে না আনোয়ারের। চাইলেই তো থামতে পারেন না আনোয়ার। কারণ, স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম স্ট্রোক করে ঘরে শোয়া। ছোট মেয়েটার বিয়ের চিন্তা, ২ লাখ টাকা ঋণের চাপ আর তিন সদস্যের ভরণপোষণের চাপ কাঁধে তার। তবে আগের মতো সপ্তাহে ৬ দিন ময়ালে বের হলেও এখন সপ্তাহে ৩-৪ দিন ফেরিতে বের হন। 

আব্দুস সাত্তার মানিক নামের এক ক্রেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বয়স এখন ৩০ এর কাছাকাছি। সেই ছোট্টবেলা থেকে আনোয়ার ভাইকে দেখতাম আমাদের গ্রামে ফেরি করতে আসতেন। প্রতি সোমবার তিনি আমাদের এলাকায় আসতেন। আমরা মায়ের কাছ থেকে দুই টাকা চেয়ে নিতাম বুট বাদাম কেনার জন্য। আজ এতগুলো বছর পরও তিনি ফেরি করে চলেছেন। 

আড্ডা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বাদল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আনোয়ার ভাইকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। ভোটার আইডিতে বয়স কিছুটা কম থাকায় বয়স্কভাতা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা এলে আনোয়ার ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা থাকবে সব সময়। 

বরুড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মেহেদী হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এ বিষয়টি এখনই জানলাম। খোঁজখবর নেব। উপজেলা প্রশাসন থেকে আনোয়ার হোসেনকে সহযোগিতার হাত বাড়ানো হবে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে।

আরিফ আজগর/এমএএস