অবৈধ উপায়ে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে ট্রলারডুবির ঘটনায় ফরিদপুরের বেশ কয়েকজন তরুণ নিখোঁজ হয়েছেন। এ পর্যন্ত নগরকান্দা উপজেলার ১২ তরুণের খোঁজ মিলছে না। তাদের মধ্যে একটি ইউনিয়নেই ১১ জন তরুণ নিখোঁজ রয়েছে বলে জানা গেছে।

ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার ডাঙ্গী ইউনিয়নের নিখোঁজ তরুণেরা হলেন- ডাঙ্গী ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামের মোস্তফা মাতুব্বরের ছেলে আল আমিন মাতুব্বর (২০), সোবাহান মোল্লার ছেলে মাহফুজ মোল্লা (২২), এসকেন মোল্লার ছেলে নাজমুল মোল্লা (২৩), সেকেন ব্যাপারীর ছেলে আকরামুল ব্যাপারী (২৭), বাঁশাগাড়ী গ্রামের ইছাহাক ফকিরের ছেলে স্বপন ফকির (২৭), শংকরপাশা গ্রামের সেকেন কাজীর ছেলে শামীম কাজী (২১), সরোয়ার মাতুব্বরের ছেলে বিপুল মাতুব্বর (২৫), মালেক শেখের ছেলে বিটুল শেখ (২৫), শ্রাঙ্গাল গ্রামের সলেমান শেখের ছেলে মিরান শেখ(২২), ইদ্রিস শেখের ছেলে তুহিন শেখ (২০) ও নারুয়াহাটি গ্রামের কাশেম তালুকদারের ছেলে শাওন তালুকদার (২২)। নিখোঁজ ওপর তরুণ হলেন উপজেলার কোদালিয়া শহীদনগর ইউনিয়নের আটকাহনিয়া গ্রামের তোরাপ মোল্যার ছেলে শফিকুল ইসলাম রাসেল (৩০)।

গত ৫ জানুয়ারি ওই তরুণরা ইতালির উদ্দেশ্যে ঢাকা যান। ঢাকা থেকে ৮ জানুয়ারি তারা দুবাই যান। দুবাইয়ে চারদিন থাকার পর মিশর হয়ে ১২ জানুয়ারি নাগাদ তারা লিবিয়া পৌঁছান। সেখান থেকে ৯ মার্চ তাদের ইতালি যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠিয়ে দেওয়া হয়।

ডাঙ্গী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী আবুল কালাম বলেন, ডাঙ্গী ইউনিয়নে এ পর্যন্ত ১১ জন তরুণ নিখোঁজ রয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। নিখোঁজ তরুণের পরিবারের সদস্যরা চরম উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে সময় পার করছেন। তাদের সন্তানেরা বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তা জানতে পারছেন না।

নিখোঁজ তরুণদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা সবাই স্থানীয় দালাল মুরাদের সঙ্গে নৌপথে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য চুক্তি করেন। সোমবার (১৪ মার্চ) দিবাগত রাত সাড়ে ৪টার দিকে নগরকান্দার তালমা ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামের আল আমিন মাতুব্বরের মা চামেলী বেগমকে এ চক্রের সদস্য কৃষ্ণনগর গ্রামের বাসিন্দা মহা ফকিরের ছেলে মুরাদ ফকির (৩৬) ইমোতে ফোন করে জানান তার ছেলেকে বহনকারী ট্রলার ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে গেছে। এখনও তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি।

এ ট্রলারডুবির ঘটনায় নিখোঁজ আল আমিনের পরিবার জানায়, গত বছর এসএসসি পাস করেছেন। এরপর তিনি আর কলেজে ভর্তি হননি। তাকে বিদেশে পাঠাতে দালাল মুরাদকে আট লাখ টাকা দিয়েছিলেন মা চামেলী বেগম।

নিখোঁজ আল আমিন মাতুব্বরের মা চামেলী বেগম বলেন, দালাল মুরাদ জানিয়েছে আল আমিনসহ ওই গ্রামের চার তরুণকে যে ট্রলারে নেওয়া হবে ওই ট্রলারে মোট ৪৭ জন ছিল। এর মধ্যে ১৭ জন জীবিত উদ্ধার হয়েছে। জীবিত উদ্ধার হয়েছে তার মধ্যে নগরকান্দার ডাঙ্গী ইউনিয়নের বিল গোবিন্দপুর গ্রামের নান্নু সররদারের ছেলে হৃদয় সরদার (২৫) ও আহমেদ ফরাজীর ছেলে রাসেল ফরাজি রয়েছে (২০)।

আহমেদ ফরাজী জানান, তার ছেলে রাসেল মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) দুপুর আড়াইটার দিকে বিদেশি একটি সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠানের ফোন থেকে কল করে জানান, ট্রলারডুবিতে তিনি ও হৃদয় সরদার জীবিত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছেন। বাকিদের কি হয়েছে তা তিনি জানেন না।

চামেলী আরও বেগম বলেন, গত ৯ মার্চ বাংলাদেশী সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তার ছেলের সঙ্গে কথা হয়। তখন ছেলে বলেছিল ভালো আছে। ওই দিন দিবাগত রাত সাড়ে ৪টার দিকে মুরাদ তাকে ইমোতে জানায় তাদের ইতালির উদ্দেশ্যে নৌযানে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত মুরাদের সঙ্গে দালাল চক্রের আরও চার সদস্য আছেন। তারা হলেন- ডাঙ্গী ইউনিয়নের মশাউজান গ্রামের ফরহাদ ফকির, বিল গোবিন্দপুর গ্রামের লিটন সরদার ও আবুল হোসেন এবং বাসাগাড়ি এলাকার কাদের মাতুব্বর। এ চক্র ৮ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে তরুণদের লিবিয়া নিয়ে নৌকায় করে ইতালি পাঠান। তবে নেওয়ার সময় তারা বলেন বড় জাহাজে করে পাঠানো হবে।

দালাল মুরাদ ডাঙ্গী ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি লিবিয়া থাকেন। কিছুদিন আগে তিনি দেশে এসেছিলেন। গত ১৫ দিন আগে তিনি লিবিয়া চলে যান। তিনিই তার আরও চার সহযোগীর সহায়তায় আট লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে ইতালি পাঠানোর কথা বলে নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাদেরকে বিদেশ যেতে উৎসাহিত করেন। মোটা বেতনের কথা বলে পরিবারের সদস্যদের প্রলুব্ধ করেন। পরে তার সহযোগীদের মাধ্যমে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে ট্রলারে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছে দেন। এ ব্যবসা করে তিনি অল্পদিনে কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। যাদেরকে নেওয়া হবে তাদের পরিবারের সঙ্গে ইমোতে যোগাযোগ করেন দালাল মুরাদ।

ডাঙ্গী ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান কাজী আবুল কালাম জানান, মুরাদ অনেককে এভাবে বিদেশে পাঠিয়েছে। তিনি ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। মানুষ সব জেনেশুনেই এই পথে পা বাড়াচ্ছে। নিজের ইচ্ছায় অতি লোভে তারা বিপদে পড়ছে।

নগরকান্দা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিরাজ হোসেন বলেন, এসব বিষয়ে থানায় কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।

প্রসঙ্গগত, লিবিয়া থেকে অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিয়ে অবৈধভাবে ইতালি অভিমুখে যাত্রা করা একটি ট্রলার রোববার (১২ মার্চ) বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে পড়ে ডুবে যায়। ওই ট্রলারে ৪৭ জন যাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ১৭ জনকে উদ্ধার করা হয়। বাকি ৩০ জন নিখোঁজ রয়েছেন।

জহির হোসেন/আরকে