কত শীতবস্ত্র আসে কিন্তু আমাদের কপালে জোটে না
জেলার পাঁচটি উপজেলার খেটে খাওয়া, দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ পড়ে চরম ভোগান্তিতে
দেশের সর্ব উত্তরের প্রান্তিক জেলা পঞ্চগড়। এ জেলা থেকে হিমালয় পর্বত অনেক কাছাকাছি হওয়ায় প্রতিবছর শীতের প্রকোপ বেশি থাকে। তা ছাড়া উত্তর দিক থেকে বয়ে আসা পাহাড়ি হিমেল হাওয়ায় শীত মৌসুমে তাপমাত্রা ২০ থেকে ৪ ডিগ্রির ঘরে নেমে আসে ৷ ফলে প্রতিবছর জেলার পাঁচটি উপজেলার খেটে খাওয়া, দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ পড়ে চরম ভোগান্তিতে।
আমি গরিব মানুষ। কয়েক বছর ধরে অসুস্থ। আগে কাজ করতে না পারলেও এখন পারি না। ক্ষোভ প্রকাম করে তিনি বলেন, সবাই শীতবস্ত্র পায়, আমি পাই না। চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে গেলে শুধু আশ্বাস দিয়ে রাখে
বিজ্ঞাপন
আজ শুক্রবার (২৫ ডিসেম্বর) পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা সারা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। টানা ৬ দিন ধরে এ জেলায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বিরাজ করছে। তা ছাড়া চলতি শীত মৌসুমে মোট ৪২ দিন এ জেলায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন তেঁতুলিয়া আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র।
এ জেলার জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ পাথর, চা-শ্রমিক ও দিনমজুর। তারা দিন আনে দিন খায়। শীত এলেই তাদের কষ্টের সীমা বেড়ে যায়। কারণ কনকনে শীতে বরফগলা নদীতে নেমে পাথর উত্তোলন ও খোলা আকাশের নিচে চা-বাগান কিংবা মাঠে-ঘাটে কাজ করতে হিমশিমে পড়তে হয় এসব নিম্ন আয়ের মানুষকে। যাদের এক দিন কাজ না করলে চুলায় হাঁড়ি বসে না, সেই খেটে খাওয়া মানুষের কনকনে শীতের কারণে কাজে যেতে পারে না। অনেকে শীতের কামড়কে উপেক্ষা করে কাজের সন্ধানে বের হলেও কখন কাজ না পেয়ে কখনো বা বিলম্বিত হওয়ার কারণে কাজে না নেওয়ায় মলিন মুখে বাড়ির পথ ধরতে হয়।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে দেখা যায়, কনকনে হাঁড় কাপানো শীত ও ঘন কুয়াশায় জবুথবু অবস্থা এ জেলা মানুষের। সকালে অনেকেই কাজের উদ্দেশে রাস্তায় এসে চা দোকানে বসে আছে। কেউ কেউ পাতলা কাপড় পরে কাঁছে। কেউ আগুন পোহাচ্ছে শরীরে উষ্ণতা দেওয়ার জন্য। তারা বলছে, কাজ করতে না পারলে তো বাসায় খাবারের কোনো জোগান হবে না। তাই রাজ্যের হতাশাও তাদের চেহারায় ফুটে উঠছে।
একদিকে নিম্ন আয়ের মানুষ ও সংসারের চাপ, অন্যদিকে শীতের থাবায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে। শীতবস্ত্রে অভাবে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। এক শান্তি কিংবা শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার আসায় তারা বিভিন্ন সসরকারি-বেসরকারি কিংবা বিভিন্নজনের মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে শুরু করলেও এতে অনেকের ভাগ্যে শীতবস্ত্র হিসেবে একটা করে কম্বল জুটলেও অনেকের কপালে জুটছে আশ্বাস। তা ছাড়া শীতের দাপট সহ্য করতে না পেরে শীত নিবারণের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব মানুষ খড়কুটো জ্বেলে তাপের আশ্রয় নিয়েছে।
উত্তরের জেলা পঞ্চগড় হিমালয়ের কারণে প্রতিবছর শীত আগে এসে শেষ চলে যায়। ফলে এখানকার যারা চা-শ্রমিক, পাথর-শ্রমিক ও দিনমজুর রয়েছেন, তারা ভোগান্তিতে পড়েন। তাদের জন্য সরকারিভাবে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের এসব শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানাচ্ছি
আনোয়ার সাদাত সম্রাট, চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ
এদিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলার পাঁচটি উপজেলার ৪৩টি ইউনিয়নের জন্য ২২ হাজার শীতবস্ত্র এসেছে এবং তা ইতিমধ্যে বিতরণ শুরু হয়েছে। এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আরও শীতবস্ত্রের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া জেলার পাঁচটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের শীতবস্ত্র কেনার জন্য মোট ৩০ লাখ টাকা হস্তান্তর করা হয়েছে। তা ইতিমধ্যে কিনে বিতরণ শুরু করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি ও সমাজিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন এলাকায় শীতবস্ত্র বিতরণ করে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
তবে সচেতন মহলের দাবি, জেলার মোট প্রায় ১২ লাখ মানুষের মধ্যে আড়াই থেকে ৩ লাখ মানুষ শীতার্ত। যে পরিমাণ শীতবস্ত্র এসেছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। ফলে কেউ শীতবস্ত্র পাচ্ছে তো কেউ পাচ্ছে না। তাই সরকারের কাছে তারা দাবি জানিয়েছেন, শীতবস্ত্র বিতরণের বাজেট বৃদ্ধি করার জন্য।
এ বিষয়ে কথা হয় জেলার সদর উপজেলার ধাক্বামারা ইউনিয়নের রাজারপাট গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ আলিমা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি গরিব মানুষ। কয়েক বছর ধরে অসুস্থ। আগে কাজ করতে না পারলেও এখন পারি না। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সবাই শীতবস্ত্র পায়, আমি পাই না। চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে গেলে শুধু আশ্বাস দিয়ে রাখে।
একই কথা বলেন বাংলাবান্ধা এলাকায় মহানন্দা নদীতে পাথর উত্তোলনশ্রমিক নকিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা কাজ করে জীবন যাপন করি। বছরে চার মাস আমরা শীতের কারণে ভালো করে কাজ করতে পারি না। আমাদের কেউই সহযোগিতা করে না। কত শীতবস্ত্র আসে কিন্তু আমাদের কপালে জোটে না।
এ নিয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট জানান, উত্তরের জেলা পঞ্চগড় হিমালয়ের কারণে প্রতিবছর শীত আগে এসে শেষ চলে যায়। ফলে এখানকার যারা চা-শ্রমিক, পাথর-শ্রমিক ও দিনমজুর রয়েছেন, তারা ভোগান্তিতে পড়েন। তাদের জন্য সরকারিভাবে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের এসব শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, পঞ্চগড়ে শীত মৌসুমে অনেক শীত অনুভূত হয়। জেলার পাঁচটি উপজেলার জন্য যে শীতবস্ত্র এসেছে, তা ইতিমধ্যে বিতরণ শুরু হয়েছে। শীতবস্ত্রের জন্য আরও চাহিদা পাঠানো হয়েছে। আর যারা প্রকৃত গরিব অসহায় ও শীতার্ত, তাদের হাতে এসব শীতবস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে।
এনএ