যে আড়তে প্রতিদিন বিক্রি হয় কোটি টাকার তরমুজ-বাঙ্গি
ধলেশ্বরী নদীর কূলঘেঁষা মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার মুক্তারপুর পুরাতন ফেরিঘাট এলাকার আড়তে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার তরমুজ ও বাঙ্গি বিক্রি হয়। দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে ট্রলারে ভরে তরমুজ আসে এই আড়তে। সারিবদ্ধভাবে নদীতে রাখা ট্রলারগুলো থেকে ঝুপড়ি ভরে তরমুজ নামানো হয় সেখানে। সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা।
রোববার (২৬ মার্চ) সরেজমিনে দেখা যায়, ফেরিঘাটের পাশে ধলেশ্বরী নদীতে রাখা বেশ কিছু তরমুজ ও বাঙ্গি ভর্তি ট্রলার। একেকটি ট্রলারে ১০ থেকে ১৫ হাজার তরমুজ রয়েছে। ট্রলার থেকে ঝুপড়ি বোঝাই করে তরমুজ ও বাঙ্গিগুলো নামানো হচ্ছে আড়তের সামনে খোলা আকাশের নিচে। সেখানে বিভিন্ন সাইজ অনুযায়ী তরমুজগুলোকে বাছাই করে রাখা হচ্ছে। তরমুজ ও বাঙ্গির পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ী ও কৃষকরা। বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগরম ফেরিঘাট এলাকা।
বিজ্ঞাপন
খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা তাদের আড়তের সামনে ১০০ হতে ১৫০টি আলাদা আলাদা সাইজের তরমুজ স্তূপ করে ডাকছেন ক্রেতাদের। ডাক শুনে দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকাররা এসে ভিড় করছেন। একজন প্রতি পিস তরমুজের দাম ডাকতে শুরু করেন। বড় তরমুজগুলো প্রথমে ২০০ টাকা করে ডাকা শুরু হয়। কেউ ২০০ টাকায় নিতে রাজি হলে তখন আবার ২১০ টাকা পিস বলে ডাকতে শুরু করেন। ২১০ টাকায় কোনো পাইকার নিতে রাজি হলে তখন তিনি একই তরমুজ ২২০ টাকা করে ডাকতে শুরু করেন। এভাবেই তরমুজ সর্বোচ্চ দামে যে কিনতে রাজি হন তার কাছে একসঙ্গে বিক্রি করা হয়।
রোববার দুপুরে এই আড়তে তুলনামূলক বড় তরমুজগুলো প্রতি পিস ২২০-২৫০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা যায়। মাঝারি সাইজের তরমুজ ১৫০-১৮০ টাকা এবং একবারে ছোট সাইজের তরমুজ ৫০ থেকে ৮০ টাকা হিসেবে বিক্রি হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ট্রলার থেকে শ্রমিকরা নামাতে শুরু করেন তরমুজ ও বাঙ্গি। বিভিন্ন সময়ে তরমুজ চাষি ও ব্যবসায়ীরা ট্রলারে ভরে তরমুজ বাঙ্গি এনে নদীর ঘাটে ভিড়িয়ে রাখেন। পরে তারা এ সমস্ত তরমুজ ও বাঙ্গি ভোর ৬টা হতে রাত ১২টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এখানকার আড়তগুলোতে তুলে বিক্রি করতে শুরু করেন। এক ট্রলার তরমুজ বিক্রি করতে অনেকের কয়েক দিনও লেগে যায়। এসব বাঙ্গি-তরমুজ কেনার জন্য মুন্সীগঞ্জ ছাড়াও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, গাজীপুর থেকেও পাইকারী ও খুচরা ক্রেতারা এখানে আসেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধুম পড়ে যায় বেচাকেনার।
আড়ত মালিক সমিতি, ব্যবসায়ী ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ থেকে ৬ বছর আগে দু-একজন আড়তদার এখানে আড়ত পেতে বসেন। সে সময় দু-চারজন ব্যবসায়ী ও কৃষক তাদের উৎপাদিত বাঙ্গি-তরমুজ নিয়ে আসতেন। তখন ক্রেতা ও বিক্রেতা ছিল খুব কম। তবে গত দুই বছরে পাল্টে গেছে এ চিত্র। ব্যাপকভাবে বেড়েছে বেচাকেনা। বেড়েছে আড়ত ও ক্রেতা-বিক্রেতা। প্রতিদিন বরিশাল, ফরিদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা থেকে এই হাটে আসে প্রায় দুই লাখ পিস তরমুজ। মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলাসহ, কুমিল্লা, চাঁদপুর থেকে আসে বাঙ্গি।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী এলাকার তরমুজ চাষি বায়েজিদ বলেন, আমরা বরিশাল থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা ট্রলার ভাড়া নিয়ে ছয়জন কৃষক তরমুজ বিক্রি করতে এই আড়তে আসছি। এ আড়তে তরমুজের দাম ভালো। এখানকার পরিবেশও ভালো। এবার এখানে প্রথম আসছি আবারো আসবো। তরমুজ নিয়ে আসতে ট্রলারে ১২ ঘণ্টা সময় লাগছে। তবে তরমুজ নিয়ে আসার সময় পথে জেলেরা নৌকা থেকে জোড় করে তরমুজ নিয়ে যায়।
এই হাটে তরমুজ কিনতে আসা রফিক হোসেন বলেন, আমি প্রতিদিন এখান থেকে তরমুজ-বাঙ্গি কিনে ভ্যানে করে নারায়ণগঞ্জের সৈয়দপুর এলাকায় নিয়ে বিক্রি করি। গত কয়েক দিনের তুলনায় তরমুজ-বাঙ্গির দাম এখন অনেকটাই কম।
রাঙ্গবালী এলাকার অপর তরমুষ চাষি রহিম খাঁ বলেন, ৫ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। এ বছর প্রায় ১০ হাজার তরমুজ বিক্রি করছি। আরও তরমুজ আছে। আগে ঢাকার আড়তে তরমুজ বিক্রি করতাম। তবে ঢাকার চেয়ে এখানে তরমুজের চাহিদা বেশি। ঢাকায় দাম ভালো পাওয়া গেলেও আড়তদাররা তরমুজ জমিয়ে রেখে নষ্ট করে ফেলতেন। এছাড়া ঢাকার শ্রমিকরাও তরমুজ চুরি করেন। এতে লাভের পরিবর্তে লোকসান গুনতে হতো। এ হাটে তরমুজের চাহিদা বেশ ভালো থাকায় তরমুজ জমে থাকে না । চুরি ও নষ্ট কোনোটাই হয় না। তাই চিন্তা করছি আগামীতেও এ হাটে তরমুজ নিয়ে আসব।
তরমুজের পাইকার ফালান মিয়া বলেন, ৩৫ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন জেলার কৃষকদের কাছ থেকে বাঙ্গি-তরমুজ কিনে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন আড়তে বিক্রি করে আসছি। ৮-১০ বছর আগে মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টি ঘাট এলাকায়ও তরমুজের ব্যবসা করতাম। এখন সবচেয়ে বড় মৌসুমী ফলের আড়ত এটি। এই আড়তে দাম, সুযোগ-সুবিধা ভালো। তাই গত ৫ বছর ধরে এখানে বাঙ্গি-তরমুজ বিক্রি করছি।
ফল বিক্রেতা তপন দাস বলেন, এই মৌসুমে অন্যান্য ফলের তুলনায় তরমুজের চাহিদা বেশি। রমজান মাস হওয়ায় চাহিদা আরও বেড়েছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের তুলনায় এ আড়তে তরমুজের দাম ও মান দুটোই ভালো।
আলিফ সাইফ ভাণ্ডার এন্টারপ্রাইজের মালিক আলামিন মুন্সী বলেন, এখানে বরিশাল অঞ্চল থেকে তরমুজ আসে। আসার পরে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকাররা এখান থেকে তরমুজ কিনে নিয়ে যান। এখান থেকে তরমুজ কিনে নিয়ে যেতে পাইকারদের কোনো সমস্যা হয় না। প্রতিদিন আমাদের এখানে কয়েক কোটি টাকার তরমুজ-বাঙ্গি বিক্রি হয়।
অপর আড়তদার আইয়ুব আলী বলেন, এখানে সকাল হতে রাত ১২টা পর্যন্ত প্রতিদিন তরমুজ-বাঙ্গি কেনাবেচা হয়। কয়েক কোটি টাকা প্রতিদিন বেচাকেনা হয় । দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা এসে মালামাল নিয়ে যান। এখান থেকে সারাদেশে নদী ও সড়ক পথে যোগাযোগ করা খুব সহজ। তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রেতা-বিক্রেতারা সহজে এসে এখান থেকে তরমুজ-বাঙ্গি কিনে নিয়ে যান।
মুক্তারপুর পুরাতন ফেরিঘাট আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ও হাজী আব্দুল মন্নাফ সুপার মার্কেটের মালিক মো.গোলাম ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এই আড়তে বর্তমানে ১২ জন আড়তদার রয়েছে। বাঙ্গি-তরমুজের জন্য এ স্থানটি মুন্সীগঞ্জ জেলার মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। ৫ বছর ধরে এখানে সবচেয়ে ভালো মানের তরমুজ-বাঙ্গি পাওয়া যায়। মুন্সীগঞ্জ জেলা ছাড়াও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীরা এখান থেকে ফল কিনে নিয়ে যান।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন এই আড়তে এক লাখেরও বেশি তরমুজ বিক্রি হয়। যার মূল্য ১ থেকে দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এছাড়াও ৫-৬ লাখ টাকা বাঙ্গি, কয়েক লাখ টাকার কলা ও খেজুরও বিক্রি হয়। মূলত তরমুজ-বাঙ্গির এই সিজনে দেড় মাস এখানে বেচাকেনা খুবই জমজমাট হয়। অন্য মৌসুমে মৌসুমী ফল এখানে বেচাকেনা হলেও এই মৌসুমটাই সবচেয়ে বেশি জমজমাট থাকে।
আরএআর