‘আমরা গরিব মানুষ বাবা। আমাদের রোজা-ঈদ বলে আলাদা কোনো দিন নেই। একদিন কাজ না করলে চুলায় হাঁড়ি উঠে না। রোজার শুরু থেকে একটা দিনও মাছ-মাংস খেতে পারিনি। দুই দিন ধরে ইফতারে সেদ্ধ আলু খাচ্ছি। আজকে ইফতার-সেহরিতে কী খাব, সেটাও জানি না। সবকিছুর দাম বেশি, ইচ্ছে হলেও মাছ-মাংস কেনার মতো সাধ্য নেই।’

শাড়ির আঁচল দিয়ে বিষণ্ন মুখের ছাপ আড়াল করার ফাঁকে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন জরিনা বেগম। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী এই নারী রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পারুল ইউনিয়নের গুঞ্জরখাঁ গ্রামের বাসিন্দা। তার স্বামী আবুল কালাম ওরফে কাইল্ল্যা পেশায় দিনমজুর। পরিবারের সাত সদস্যের মুখে দুবেলা দু-মুঠো ভাত তুলে দিতে গতরখাটা পরিশ্রম করতে হয় তাকে।

উপার্জনক্ষম বড় ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। হঠাৎ ওই ছেলের মৃত্যুতে জরিনার সংসারে নেমে এসেছে নিদারুণ কষ্ট। ছোট ছেলে বিয়ে করে থাকেন আলাদা। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন কিন্তু সেই সংসারেও অভাব পিছু ছাড়েনি। এ কারণে মেয়ের ঘরের দুই নাতনি এখন জরিনার সঙ্গী।

মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) বেলা আড়াইটার দিকে জরিনার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, খড়কুটোয় আগুন জ্বালিয়ে চুলায় চালের হাঁড়ি বসিয়েছেন। ভাত রান্নার পর বসবে তরকারির হাঁড়ি। তবে কী তরকারি রান্না হবে সেটা তখনো অজানা, কারণ তার স্বামী কাজ থেকে বাড়ি ফিরেনি। যদি গাছ কাটায় (পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা) বেশি রোজগার হয়, তবেই তরকারির হাঁড়িতে ভালো কিছু জুটবে।

ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে জরিনা বেগম বলেন, এখন কোনোরকমে দিন যায় দিন আসে। সংসারে দুবেলা ঠিকমতো খাবারের নিশ্চয়তাও নেই। একজন মানুষের আয়ের সংসার। বৃদ্ধ স্বামী একদিন কাজে না গেলে চুলায় হাঁড়ি উঠে না। বড় ছেলের বউ-বাচ্চা আমার ঘরে খায়। সঙ্গে মেয়ের দুই সন্তানও আছে। হাঁড়ির হিসাব মিলাতে পারি না, সেহরি-ইফতারের খবর করে লাভ কী?

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, গেল চার রোজার দুই দিন ইফতারে সেদ্ধ আলু খাইছি। রাতে ডিম ভাজা দিয়ে সেহরি করছি। এখন তো ডিমের দামও বেশি। প্রথম রমজানের দিন ছোট মাছ সস্তায় মিলেছিল। সেটা দিয়ে রোজা শুরু করছি। এরপর থেকে নিরামিষ তরকারি করতেই হা-হুতাশ। ব্রয়লার মুরগি আর গরুর মাংস তো একেবারেই খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রতিবেশী আবু বক্কর জানান, জরিনার স্বামী গ্রামে বাড়ি বাড়ি গাছগাছালি পরিষ্কার করে আবার কখনো গাছ কাটার কাজ করেন। তাতে দিনে ২০০-৪০০ টাকা যা আয় হয়, ওই টাকায় কোনোরকমে তাদের সংসার চলছে। সংসারের হাল ধরার মতো কেউ নেই। এছাড়া প্রতিদিন তো গাছ কাটার কাজও থাকে না।

একই গ্রামের সৈয়দ বোরহান কবীর বলেন, মাস দেড়েক আগে জরিনাকে বাজারে ব্রয়লার মুরগির চামড়া-পা কিনতে দেখেছি। এরপর আর ভালো তরকারি কিনতে দেখিনি। তাদের আবাদ-সুবাদ নেই, গরিব মানুষ। সংসারে টানাপোড়ন, তারপর মাসে মাসে কিস্তি দিতে হয়। এই রমজানে কী খাচ্ছে সেটা জানি না। তবে আমাদের উচিত জরিনাদের মতো মানুষদের খোঁজখবর নেওয়া।

স্থানীয় পারুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি খোঁজ নিয়ে ওই পরিবারকে সহযোগিতার চেষ্টা করবো। তবে এখনই তাদের জন্য কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি সাত-আট দিন পর যতটুকু পারি তাদের জন্য চেষ্টা করবো।

তিনি সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াও সমাজের বিত্তবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অসহায় ও গরিব মানুষদের পাশে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

এদিকে রংপুরের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সারা দেশের মতো রংপুরেও মুরগির বাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও বেড়েছে ডিমের দাম। এতে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। বর্তমানে গরুর মাংস ৬৭০-৭০০ টাকা, খাসির মাংস ৮৫০-৯০০ টাকা, দেশি মুরগি ৫৫০-৫৮০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩৩০ টাকা ও ব্রয়লার মুরগির মাংস ১৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ডিম প্রতি হালি ৪৪-৪৮ টাকা, মোটা বেগুন কেজি প্রতি ৫০ টাকা, চিকন বেগুন ৪০ টাকা, টমেটো ৪০ টাকা, লেবু এক হালি ৪০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৩০ টাকা কেজি, বটবটি ৮০ টাকা, পেঁয়াজ ৪৫-৫০ টাকা, মরিচ ৮০ টাকা ও শজনে ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

রংপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ফারহান লাবীব জিসান বলেন, রমজান ঘিরে প্রতিনিয়ত বাজার মনিটরিং চলছে। কোথাও কোনো অভিযোগ পেলে সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কেউ বেশি দামে পণ্য বিক্রি করলে তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় আনা হচ্ছে। জনস্বার্থে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমজেইউ