অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে দরিদ্রতা ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছেন রাজবাড়ীর পাচুঁরিয়া ইউনিয়নের ৭৬ বছরের আব্দুল গফুর মল্লিক। জন্ম থেকে চোখে না দেখলেও ভিক্ষা না করে নাড়ু, বাদাম ও টেস্টি হজমি বিক্রি করে সংসার চালান তিনি। 

রাজবাড়ী সদর উপজেলার পাঁচুরিয়া ইউনিয়নের খোলাবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল গফুর মল্লিক। জন্মের পর থেকেই তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। দরিদ্র পরিবারে জন্ম হওয়ায় ১৬ বছর বয়সে তার বাবা তাকে বাস-ট্রেনে ভিক্ষা করতে বলেন। বাবার কথায় কষ্ট পেয়ে জিদ করে ৫ প্যাকেট বিড়ি কিনে ব্যবসা শুরু করেন গফুর। সেই থেকে তার ব্যবসার শুরু। প্রথম দিকে অন্ধত্ব নিয়ে ফেরি করে বিড়ি সিগারেট বিক্রি করতেন। এরপর থেকে নিজের তৈরি নারিকেলের নাড়ু, বাদাম ও টেস্টি হজমি বিক্রি করে সংসার চালিয়ে আসছেন জন্মান্ধ গফুর মল্লিক। জন্ম থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি।

নাড়ু তৈরি ও বাদাম ভাজাসহ সব কাজে সহযোগিতা করেন তার স্ত্রী নুরজাহান বেগম (৫৫)। কোনো সন্তান নেই গফুর-নূরজাহান দম্পতির। তাই বড় ভাই কেরামত মল্লিকের ছেলে বাতেন মল্লিককে ছোটবেলা থেকে নিজ সন্তানের মতো লালন-পালন করেছেন তারা। বাতেনও তাদের দেখেন বাবা-মায়ের মতো।

সরেজমিনে দেখা যায়, বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গেছে আব্দুল গফুর মল্লিকের শরীর। ঠিকমতো হাঁটতেও পারেন না তিনি। কথাও বলেন অস্পষ্ট। তবুও অন্যের কাছ থেকে হাত পেতে কিছু চান না তিনি। কেউ কিছু দিতে চাইলেও তিনি নেন না।

সকালে বাড়ি থেকে টিনের কনটেইনারে করে নাড়ু ও প্লাস্টিকের ঝুড়িতে করে বাদাম নিয়ে বের হন তিনি। হেঁটে হেঁটে বাদাম আর নাড়ু বিক্রি করে রাতে বাড়ি ফিরে আসেন। কেউ কিছু সেধে দিলেও নিতে চান না গফুর। এলাকার লোকজনের কাছে গফুর মল্লিক একজন সৎ মানুষ হিসেবে পরিচিত। এই বয়সেও ভিক্ষা না করে উপার্জন করে খাওয়ায় সবাই শ্রদ্ধা করে তাকে।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আব্দুল গফুর মল্লিক বলেন, আমার যখন ১৬ বছর বয়স তখন আব্বা বলেছিল বাস-গাড়িতে ভিক্ষা করতে। কিন্তু আমি আব্বার কথায় কষ্ট পেয়ে জিদ করে ব্যবসা শুরু করি। আমি কখনো চাইনি ভিক্ষা করে, মানুষের কাছে হাত পেতে খেতে। তাইতো আমি ১৬ বছর বয়স থেকে এখন পর্যন্ত ব্যবসা করে খাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, ভিক্ষা করলে মানুষ ঘৃণা করত। ষোল আনার মধ্যে বারো আনা মানুষই খারাপ ভাবত। তাই অন্যের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে আমি নিজে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছি। আমার ৭৬ বছর জীবনে আমি কারোর কাছে হাত পাতিনি। বাদাম, নাড়ু ও টেস্টি হজমি বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাই।

গফুর মল্লিকের স্ত্রী নূরজাহান বেগম বলেন, আত্মসম্মান বোধ থেকে আমার স্বামী ভিক্ষা করে না, কারোর কাছে হাত পাতে না। কেউ কিছু দিতে চাইলেও সে নেয় না। তার সঙ্গে সংসার জীবনে আসার পর থেকেই দেখে আসছি সে ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছে। আমি তাকে কাজে সাহায্য করি। নারিকেলের নাড়ু বানিয়ে দেই, বাদাম ভেজে তা প্যাকেট করে দেই। সে ওই গুলো নিয়ে গ্রামের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে। সে যা আয় করে তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে।

গফুর মল্লিকের ভাইয়ের ছেলে বাতেন মল্লিক বলেন, গফুর চাচাকে আমি বাবার মতোই দেখি। তার সন্তান না থাকায় সে আমাকে তার সন্তানের মতো লালনপালন করেছে।গফুর চাচা জন্ম থেকেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি সে কখনো কারোর কাছে হাত পাতেনি। জীবিকা নির্বাহের জন্য সে নাড়ু ও বাদাম বিক্রি করে। এই কাজে আমার চাচি তাকে সাহায্য করে থাকে।

স্থানীয় আজিবর ব্যাপারী বলেন, গফুর মল্লিক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও সে কারোর কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতে না।

রাজবাড়ী সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মার্জিয়া সুলতানা বলেন, গফুর মল্লিক সরকারের প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। এছাড়াও আমরা তাকে আরও কিছু সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনতে চেয়েছি যেহেতু সে জন্ম থেকেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ও বেশ অক্ষম। কিন্তু তিনি তার আত্মসম্মান বোধ থেকে আমাদের কোনো সুযোগ-সুবিধা নেননি। সে বাদাম ও নাড়ু বিক্রি করেই তার জীবিকা নির্বাহ করতে চায়। আমাদের সমাজের জন্য তিনি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

মীর সামসুজ্জামান/আরকে