প্রতিষ্ঠার ১০ বছর অতিক্রম করছে দক্ষিণাঞ্চলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি)। ইতোমধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠা পায়নি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার। কমানো হচ্ছে গবেষণা বাজেট। ফলে গবেষণায় প্রতিবন্ধকতা আর অন্যের দ্বারস্থ হয়ে চলছে গবেষণাকর্ম, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল এমনটা জানায়।

অথচ অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে গবেষণাগারের মানোন্নয়ন করা হলে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণায় অবদান রাখতে পারত বিশ্ববিদ্যালয়টি। এখন গবেষণাহীন উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি আনলেও তা সুফল বয়ে আনছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মনে করছে, গবেষণাগার না থাকলেও বিকল্প পথে গবেষণাকর্ম চালিয়ে যেতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারের দুটি শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার গড়ে উঠবে বলে আশা করছে প্রশাসন।

২০১১ সালে বরিশাল সদর উপজেলার কর্ণকাঠিতে স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়টি নগরের জিলা স্কুলের তিনটি ভবনে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির ছয়টি অনুষদের ২৪টি বিভাগে প্রায় সাত হাজার শিক্ষার্থী রয়েছেন। ১৯৩ জন শিক্ষকের মধ্যে অনেকেই গবেষণা করছেন ব্যক্তি উদ্যোগে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচেও গবেষণার অনুমতি মেলে। তবে সেই সংখ্যা নিতান্তই কম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ২০২০ সালে গবেষণায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ইলিয়াস মাহমুদ। তিনি ‘পিট ল্যাট্রিন বা আধাপাকা টয়লেট থেকে ভূগর্ভস্থ পানিদূষণ কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করেন। তার প্রবন্ধ আমেরিকান ক্যামিকেল সোসাইটি (এসিএস) থেকে প্রকাশিত গবেষণা পত্রিকা ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’তে ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়। যে গবেষণাকর্মটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক একাডেমিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণা প্রকাশনী সংস্থা ‘নেচার’ পরিচালিত ‘নেচার ইনডেক্স ২০২০’-এ স্থান পায়। প্রতিবছর বিশ্বের ৮২টি গবেষণাপত্র এই ইনডেক্সে অন্তর্ভুক্ত হয়, যা ওই বছরের সেরা গবেষণা থিসিস বলে বিবেচ্য।

ইলিয়াস মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ-সুবিধা সমান হবে না, এটাই স্বাভাবিক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তার মধ্য থেকেই আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও চেষ্টা করছে সীমাবদ্ধতা কাটানোর। সরকার গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করছে। প্রণোদনা দিচ্ছে।

প্রতিষ্ঠার ১০ বছরে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা উচিত ছিল কি না, প্রশ্নের জবাবে এই গবেষক বলেন, এত দিনে হয়তো প্রতিষ্ঠা করা যেত।

চলতি বছর বায়ো মেমব্রেন নিয়ে গবেষণা করে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে বেস্ট পোস্টার অ্যাওয়ার্ড জিতেছে গবেষক দল। ১৭৫টি থিসিসের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. খোরশেদ আলমের গবেষক দল।

ঢাকা পোস্টকে খোরশেদ আলম বলেন, জীবাণুনাশক ওষুধকে বলা হয় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্ট। এর মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক একটি। ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকা অথবা প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করা ব্যাকটেরিয়ার একটি সহজাত প্রক্রিয়া। এটি মূলত শুরু হয় ব্যাকটেরিয়ার জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। এটি তখনই ঘটে, যখন কোনো এক প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া কোনো এক সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিকের সম্মুখীন হয়, অ্যান্টিবায়োটিক থেকে নিজেদের বাঁচাতে ব্যাকটেরিয়া হয় নিজেদের কোনোভাবে পাল্টে ফেলে অথবা এমন সব রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে, যা দিয়ে অ্যান্টিবায়োটিককে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা যায়।

তিনি আরও বলেন, মেগাইনিন-২ নতুন প্রজন্মের একটা এন্টিমাইক্রোবিয়াল পেপটাইড (অগচ), যা ব্যাঙের ত্বকে পাওয়া যায়। এই পেপটাইড যখন ব্যাকটেরিয়ার ওপর প্রয়োগ করা হয়, তখন এটি সরাসরি ব্যাকটেরিয়া সেলের মেমব্রেনে গিয়ে আঘাত করে মেমব্রেনে ন্যানো সাইজের সৃষ্টির মাধ্যমে ওই ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার কার্যক্ষমতা নষ্ট করতে পারে। এটা নিয়ে অনেকভাবে গবেষণা হচ্ছে। এই চলমান প্রক্রিয়ায় আমরা আর্টিফিশিয়াল সেল তৈরি করে কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে ন্যাচারাল সিস্টেমে সংঘটিত মেকানিজমগুলো জানার চেষ্টা করছি।

দীর্ঘদিন জাপানে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকর্ম চালানো বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. খোরশেদ আলম মনে করেন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে গবেষণাকর্ম। কলেজে শুধু থিওরেটিক্যাল লেখাপড়া করোনা হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকে মুখ্য ধরা হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার গড়ে ওঠেনি। যে কারণে যারা গবেষণা করছেন, তাদের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলাবোরেশনে কাজ করতে হচ্ছে। এটি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই করছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রকল্পের কাজ ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সেই কাজ এখনো শেষ হয়নি। ফলে নতুন প্রকল্প আসছে না। এ জন্য আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগারও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণায় অনুদানপ্রাপ্ত ড. মাহফুজ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গবেষণার অনেকগুলো সেক্টর রয়েছে। কে কোন বিষয়ের ওপর গবেষণা করেন, তার ওপর নির্ভর করে তার সুযোগ-সুবিধা। আমি গবেষণা করছি, অ্যাডভান্স রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে অ্যাডভান্স ন্যানো টেকনোলজি নিয়ে। এ ধরনের গবেষণাগার বাংলাদেশে নেই।

ড. মাহফুজ আরও বলেন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অপেক্ষাকৃত একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম চালানোর মতো অবকাঠামো নেই। সে ক্ষেত্রে এই ধরনের গবেষণাগার হয়তো অদূর ভবিষ্যতে হবে।

এখানে গবেষণা করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয় উল্লেখ করে ড. মাহফুজ আলম বলেন, গবেষণাকর্ম চালাতে গিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোলাবোরেশনে যেতে হয়। কিন্তু আমার গবেষণাগারে যদি ন্যূনতম সরঞ্জামাদি না থাকে, তাহলে অন্য কেউ তো আমার সঙ্গে কোলাবোরেশনে যাবে না। আমার ক্ষেত্রে সেই কোলাবোরেশনটুকুও করা সম্ভব হচ্ছে না।

আরেক গবেষক প্রভাষক সাইফ ইশতিয়াক ঢাকা পোস্টকে বলেন, অপেক্ষাকৃত নতুন বিশ্ববিদ্যালয় এটি। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়টি উন্নয়ন কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, সেখানে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার রাতারাতি প্রস্তুত করা সম্ভব নয়। এ জন্য আমরা কোলাবোরেশন ওয়ার্কের প্রতি জোর দিচ্ছি বেশি। ১০ বছরে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা যেত কি না, প্রশ্নের জবাবে এই গবেষক বলেন, হয়তো যেত, কিন্তু আমি ওই বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না।

গবেষণাগারের সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ছাদেকুল আরেফিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারগুলোকে সঠিকভাবে প্রস্তুত করার জন্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামোগত কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।

উপাচার্য বলেন, একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করতে হলে ভবন দরকার; অবকাঠামোগত সেই সমস্যা রয়েছে। মূল সমস্যাই হচ্ছে অবকাঠামো সমস্যা। গবেষণাগারের জন্য ভবন নির্মাণ করা হলে গবেষণায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে আসা সম্ভব। তবে যেহেতু এখনো আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার নেই, সে জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই (এমইইউ) হয়েছে। আণবিক শক্তি কমিশনের সঙ্গে এমইইউ হচ্ছে। যেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্চতর গবেষণা চালিয়ে যেতে পারেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে গবেষকদের সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে বলে জানান উপাচার্য।

এনএ