প্রতারণার শিকার মিনাজ উদ্দীন

ফোন করে প্রথমে কোরআন শরিফ ও জায়নামাজের পাটি দাবি করেন জিনের বাদশা। সেগুলো পেয়ে খুশি হয়ে একটি  ‘স্বর্ণের পুতুল’ উপহার দেন। তার গড়া মসজিদে কোরবানির গরু কেনার টাকা দিলে রাতারাতি ধনী করে দেবেন বলে জানান। এমন সব প্রলোভনে কথিত জিনের বাদশার খপ্পড়ে পড়ে লাখ টাকা খুইয়ে দিশেহারা মিনাজ উদ্দীন নামে এক ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ী।

মিনাজ উদ্দীন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মধুহাটি ইউনিয়নের গোপালপুর বাজারের ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ী ও দুর্গাপুর গ্রামের মো. আছমত মন্ডলের ছেলে। 

প্রতারণার শিকার মিনাজ উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বুধবার (১৭ মার্চ) ফজরের নামাজ শেষে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে আমার মোবাইলে কল আসে। কল রিসিভ করার পর প্রথমে জিনের বাদশা পরিচয় দিয়ে বলে- ‘তুমি কি নামাজ পড়ো।’ উত্তরে আমি বলি- ফজরের নামাজ পড়েই আসলাম। তখন সে বলে- ‘তুমি এখন দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নাও।’ নামাজ শেষ হলে বলে- ‘আমি জিনের বাদশা, দিনাজপুর সৌর মসজিদে থাকি। ইমামের কাছেই থাকি এবং তার মাধ্যমেই কথা বলছি। তোমার কাছে বিশেষ আবেদন, আমাদের এখানে মসজিদে তিনটা কোরআন শরিফ এবং একটা জায়নামাজের পাটি দিতে হবে।’

আমি গুরুত্ব না দিয়ে বলি হ্যাঁ দিব। এরপর আবেদন অনুযায়ী কোরআন শরিফ ও জায়নামেজের পাটি না দেওয়ায় রাত সাড়ে ১২টার দিকে আমাকে ফোন দিয়ে বলে- ‘তুই আমার শর্ত রাখিসনি। তোর সন্তান কিন্তু মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মারা যাবে, তুই কি তোর ক্ষতি চাস।’ এ কথা শুনার পর ভয়ে আমি তাদের বিকাশ নম্বরে ১ হাজার ৫০ টাকা পাঠিয়ে দেই। 

পরদিন রাত ১টার জিনের বাদশা পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি অনেকক্ষণ কোরআন তেলওয়াত করে বলে- ‘তুই অনেক পূর্ণ কাজ করেছিস। আমরা ৭০ হাজার সাহাবী এবং অলিআউলিয়া মিলে তোর জন্য দোয়া করছি। তুই এখন দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নে। আগামী দুই দিন রোজা থাকতে হবে। তাহলে সবাই তোর প্রতি সন্তুষ্টি থাকবে। তোকে আমরা অনেক কিছু দিব। তোর গ্রাম থেকে কাছের তিনটা বাজারের নাম বল।’

তখন আমি গোপালপুর, ভিকের মোড় ও আটলিয়া বাজারের নাম বলি। জিনের বাদশা বলে- ‘তুই এই মুহূর্তে নিকটের যে কোনো একটা বাজারে আসতে পারবি? তোকে আমরা একটা স্বর্ণের পুতুল উপহার দিব।’

মিনাজ উদ্দীন বলেন, এ কথা শুনে আমার ভেতরে লোভ কাজ করে। আমি বলি- এতো রাতে আসতে পারবো না, কাল সকালে বা দিনের বেলায় যাব। এরপর পরদিন সকাল ৮টার দিকে আবারও জিনের বাদশা ফোন করে বলে- ‘বাবা তুমি এই মুহূর্তে আটলিয়া বাজারে যাও। সেখানে তোমার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।’ এরপর হেঁটে বাজারের কাছাকাছি গেলে বলে- ‘সামনে একটা ব্রিজ দেখতে পাচ্ছো, সেখানে ব্রিজের ওপর কাগজে মোড়ানো কিছু দেখতে পাবে। সেটা খুললে সোনার পুতুল পাবে।’ 

সেখানে গিয়ে দেখি কিছুই নেই। আবারও জিনের বাদশা বলে- ‘আমাদের একটু সমস্যা হয়েছে। আমরা আটলিয়া বাজারের মসজিদে আছি। তুমি এখানে চলে আসো।’ আমি সেখানে গিয়ে মসজিদে তালা মারা দেখতে পাই।

জিনের বাদশা বলে- ‘পাশেই দেখো টিউবওয়েল আছে সেখানে যাও, ওখানে দেখ একটা বদনা আছে।’ বদনাটা উঁচু করে আমি স্বর্ণের রঙের পুতুল দেখে হতবাক হয়ে যাই। তখন আমার বিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়। সে আমাকে বলে- ‘তুমি সোজা বাড়ি গিয়ে পুতুলটি ঘরের মেঝেতে পুঁতে রাখবে এবং বিষয়টা কাউকে বলা যাবে না। বিষয়টি জানাজানি হলে তোমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’

মিনাজ উদ্দীন আরও বলেন, এ ঘটনার পরদিন রাতে আবারও আমাকে ফোন করে বলে- ‘তোমাকে দিয়ে তোমার এলাকায় মসজিদ, মাদরাসা, এলাকার অসহায় মানুষের সেবা করাতে এবং তোমার ছেলেকে কোরআনের হাফেজ বানাতে চান জিনের বাদশা।’ আমি বলি আমার তো কোনো টাকা-পয়সা নাই। তখন সে বলে- ‘তোমাকে টাকার চিন্তা করা লাগবে না। তোমার টাকার ব্যবস্থা আমরা করে দিবো। আমাদের এখানে একটা গরু কোরবানি দিতে হবে। জিনের বাদশার খুশির জন্য তোমাকে এই গরু ক্রয়ের টাকা দিতে হবে। তোমার বাজারের যে কোনো বিকাশের দোকান থেকে ৪১ হাজার টাকা দাও। ১৫ মিনিট পর তা দুইগুণ হয়ে তোমার বিকাশ নম্বরে চলে যাবে।’

তখন আমি তাদের দেওয়া নম্বরে পাশের বিকাশের দোকান থেকে ৪২ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেই। এরপর তারা বলে- ‘বর্তমানে গরুর বাজার অনেক বেশি। এখানেও অনেক সাহাবীগণ রয়েছে। তাদের খাওয়াতে দুইটা গরু কিনতে হবে।’ এরপর আমি আরও ৪০ হাজার টাকা পাঠাই। টাকা পাঠানোর এক ঘণ্টা পার হলেও তারা আমার বিকাশে আর টাকা পাঠায়নি। এরপর আমি বাড়ি চলে যাই। 

পরদিন আবারও ফোন করে বলে, ‘গতকাল জিনের বাদশার সমস্যা হয়েছিল। তার আদেশে তোমাকে নগদ টাকা দিব। এ কারণে আমরা তোমার বাজারের মসজিদে টাকার ব্যাগ নিয়ে আসছি। তুমি বিকাশে ২১ হাজার টাকা পাঠিয়ে দাও।’ আমি আবার তাদের কথামত টাকা পাঠিয়ে দেই। তারপর থেকে নানা তালবাহানা করে তারা আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি। পরবর্তীতে ফোন নম্বরটাও বন্ধ করে রাখে। তখন আমি চিন্তা করি জিনের দেওয়া স্বর্ণের পুতুল বিক্রি করে বিকাশের টাকা পরিশোধ করবো। আমি বাড়িতে গিয়ে মাটি খুঁড়ে পুতুলটি ভাঙি। পুতুলটির হাত ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে দেখি সেটি স্বর্ণের না। তখন আমার সেন্স ফিরে আসে। 

মিনাজ উদ্দীন বলেন, আমার লোভ-লালসায় আমি এখন সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। এতোগুলো টাকা আমি কীভাবে পরিশোধ করবো।

গোপালপুর বাজারের বিকাশ এজেন্ট মো. বাবুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিনাজ আমার পাশেই ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ব্যবসা করে। ওই দিন সকালে আমার দোকানে এসে বলে, গরমে ফ্যানের দাম বেড়ে যাবে। এজন্য বেশি করে ফ্যান কিনবে, জরুরিভাবে তার মহাজনের কাছে টাকা পাঠাতে হবে। তখন আমি ০১৩০২-১৬২২০৯ ও ০১৮৯২-১৯৫৬৫১ নম্বরে ৮২ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেই। এরপর আমি টাকা চাইলে বলে একটু পরে দেবে। এ ঘটনার একদিন পর অন্য দোকান থেকেও সে টাকা পাঠিয়েছে। তারপর আমরা জানতে পারি সে আসলে জিনের বাদশার খপ্পড়ে পড়েছে। 

মধুহাটি ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. শহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিনাজ বাজারে দীর্ঘদিন ধরে ইলেকট্রনিক্সের ব্যবস্যা করে আসছে। সে একজন সহজ-সরল মানুষ। জিনের বাদশা সেজে প্রতারক চক্র তার সরলতা কাজে লাগিয়ে এবং তাকে বিভিন্নভাবে লোভ দেখিয়ে তার কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই প্রতারক চক্রকে চিহ্নিত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ঘটনায় ঝিনাইদহ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার প্রক্রিয়া চলছে বলেও তিনি জানান।

আব্দুল্লাহ আল মামুন/আরএআর