চিকিৎসা বিজ্ঞানে মাদকাসক্তিকে দেখা হয় মানসিক রোগ হিসেবে। বরিশালে সেই রোগের চিকিৎসা চলছে আবদ্ধ কক্ষে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে। নির্যাতনে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও সশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সঠিক মনিটরিং না থাকায় দিনে দিনে ‘টর্চার সেল’ হয়ে উঠছে মাদক নিরাময় ও মানসিক রোগীর চিকিৎসা কেন্দ্র।

বরিশাল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, বিভাগের ছয়টি জেলায় মোট আটটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া আছে। এর মধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠান বরিশাল শহরে। স্বপ্ন নামে বাকি একটি পটুয়াখালীতে প্রতিষ্ঠিত হলেও সেটি বন্ধ রয়েছে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে তরুণ কান্তি গায়েনের পরিচালনায় ক্রিয়া, হাফিজুর রহমানের ড্রিম লাইফ, গোলাম মর্তুজা জুয়েলের দি নিউ লাইফ, শাহরিয়ার রিপনের দি লাইফ কেয়ার। মোস্তাফিজুর রহমানের হলি কেয়ার, মাইন্ড কেয়ার এবং সেভ দ্যা লাইফ। স্বপ্নের মালিকানাও এই মোস্তাফিজুর রহমানের। তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রোগী মৃত্যু ও নির্যাতনের অভিযোগও সবচেয়ে বেশি।

সরেজমিনে সাতটি প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, শুধুমাত্র দি নিউ লাইফ ও ড্রিম লাইফে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়ন রয়েছে। বাকি পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে ভলান্টিয়াররাই চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মাইন্ড কেয়ারে সাংবাদিক প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ক্রিয়া মাদক নিরাময় কেন্দ্রে দুপুরে দুটি আলু ভর্তা, এক প্লেট ভাত ও এক গ্লাস পানি খেতে দিতে দেখা গেছে রোগীদের।

হলি কেয়ার মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালক মাইনুল হক তমাল বলেন, আমাদের এখানে ২৪ ঘণ্টা কোনো ডাক্তার নেই। তবে দক্ষ ব্রাদার রয়েছেন। চিকিৎসকের প্রয়োজন হলে কল করি। তখন চিকিৎসক চলে আসেন।

সেইফ দ্যা লাইফের পরিচালক সখাওয়াত হোসেন বলেন, ভলান্টিয়াররাই রোগীদের ট্রিটমেন্ট দিয়ে থাকেন। এই ভলান্টিয়ার আবার বাইরের কেউ না, যারা আগে মাদকাসক্ত ছিল কিন্তু রিহ্যাব সেন্টারে এসে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছে তারাই ভলান্টিয়ার হিসেবে চিকিৎসা দেন।

মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন একাধিকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভর্তির পর অভিভাবকদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে একাকিত্বের মধ্যে ফেলা হয়। এরপরই মূলত নির্যাতন শুরু করে বিভিন্ন উপায়ে। টয়লেটে ঢুকিয়ে মুখে গামছা ঢুকিয়ে মারধর, সাউন্ড বক্সে উচ্চ শব্দে গান ছেড়ে মারধর, রাতে টয়লেটের সামনে শুতে বাধ্য করা, রাত ৩/৪টার দিকে ঘুম থেকে তুলে সকল রোগীর জন্য রুটি বা খাবার তৈরি করা ইত্যাদি। মারধরের সময়ে হাত-পা রশি বা হাতকড়া দিয়ে বেঁধে রাখা হয়।

মাইন্ড কেয়ার থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ না হওয়া এক রোগীর স্বজন বলেন, ২২ দিনে ৪৫ হাজার টাকা ব্যয় দেখিয়েছে। কিন্ত আমার মা সুস্থ হননি। তিনি সিজোফ্রোনিয়ায় আক্রান্ত। ভর্তির সময়ে মাইন্ড কেয়ারের লোকজন বলেছিল ৮ হাজার টাকা। ভর্তির পর বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা, ওষুধ, ডাক্তারের ভিজিট দেখিয়ে ৪৫ হাজার টাকা বিল করেছে।

হলি কেয়ার থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফেরা এক যুবক জানান, মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে কোনো চিকিৎসা নেই। ওখানে মারধর করেই আতঙ্কগ্রস্ত করা হয়। আতঙ্কে অনেক মাদকাসক্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন। এরপর তার পরিবারকে ডেকে এনে দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে সুচিকৎসা কিন্তু তিনি পাননি। বাসায় ফিরে আবারো মাদকে জড়িয়ে পড়েন।

দি নিউ লাইফের দায়িত্বরত চিকিৎসক মুফতি আল মাহিদ বলেন, এটি দুঃখের বিষয় যে মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে মারধরকেই চিকিৎসা হিসেবে অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু মারধর কোনো চিকিৎসা না। উল্টো অসুস্থ রোগীকে মারধর করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হলো।

ড্রিম লাইফের চেয়ারম্যান নাজমুল হাসান বাপ্পী জানান, মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক সংকট বরিশালে প্রকট। পুরো বিভাগে ২/৩ জন চিকিৎসক রয়েছেন। আবার অনেক চিকিৎসক রয়েছেন যারা মাদক নিরাময় কেন্দ্রে আসতে চান না। ফলে চাইলেও তাৎক্ষণিক সুচিকিৎসা দেওয়া কষ্টসাধ্য।

বরিশালের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. সব্যসাচী দাস বলেন, মাদক নিরাময় পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসক থাকা বাঞ্ছনীয়। যদি ২৪ ঘণ্টা রাখা সম্ভব নাও হয় তবে প্রতিদিন খণ্ডকালীন হলেও চিকিৎসক রাখা উচিত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বরিশালের পরিচালক ডা. হুমায়ূন শাহীন খান বলেন, চিকিৎসার প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসক থাকা বাধ্যতামূলক। তবে বরিশালে যেসব মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে তারা তা স্বাস্থ্য দফতরের কোনো অনুমতি নিয়ে পরিচালনা করে বলে জানা নেই। এসব প্রতিষ্ঠান কীভাবে চিকিৎসা দিচ্ছে তা আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালে উজিরপুরের গুঠিয়ার জাকির নামে এক রোগী মারা যান হলি কেয়ারে। ২০১৫ সালে একই প্রতিষ্ঠানে মারা যান নগরীর কাঠপট্টি এলাকার বাসিন্দা পুলক। ২০২১ সালে হলি কেয়ারের বাথরুম থেকে চন্দন সরকারের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি সেভ দ্যা লাইফে সোহেল নামে (৩২) এক যুবকের মৃত্যু হয়। ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর ড্রিম লাইফের কর্মীদের হাতে মারা যান সুমন খান (৩০) নামে এক যুবক।

এই পাঁচজনের মৃত্যুর বিষয়ে পরিবার থেকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ তোলা হয়েছে। এসব ঘটনায় থানায় মামলা ও অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হন। পরবর্তীতে মামলা ধামাচাপা পড়ে যায়।

আরএআর