৮০ টনের ট্রান্সফরমারটি পৌঁছে দিতে সকল ব্যবস্থা করার দায়িত্ব ছিল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের। সড়ক সার্ভে করে ট্রান্সফরমারটি পাঠানোর কথা ছিল। কথা ছিল বিকল্প ব্যবস্থা তৈরির। কিন্তু এতসবের কিছুই না করে ট্রান্সফরমারটি পাঠানো হলে ঘটে দুর্ঘটনা। এতে সরকারের অন্তত ৩০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। আর এ ক্ষতির দায় পড়েছে লরি চালকের কাঁধে। অথচ দায় বহন করার কথা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ট্রান্সফরমারটি সরবরাহের এমন নানা অনিয়মের চিত্র।

ময়মনসিংহের কেওয়াটখালি গ্রিডের ট্রান্সফরমার বিকল হয়ে পড়ে গত ২৪ এপ্রিল। চুক্তি অনুযায়ী নতুন আরেকটি ট্রান্সফরমার পৌঁছানোর জন্য এনার্জিপ্যাক নামের প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয় পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি)। এরই প্রেক্ষিতে গত ২৬ এপ্রিল ৮০ টন ওজনের একটি ট্রান্সফরমার পাঠায় প্রতিষ্ঠানটি। ওইদিন সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে ট্রান্সফরমারবাহী লরিটি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ত্রিশালের চেলেরঘাট বেইলি সেতু পারাপারের সময় সেতুটি ভেঙে লরি নদীতে পড়ে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভেঙে পড়া ওই সেতুর সক্ষমতা ছিল ৩৬ টন। কিন্তু ৮০ টনের ট্রান্সফরমার বহনের বিষয়ে কোনো কিছুই জানানো হয়নি সড়ক ও জনপথ বিভাগকে। শুধু তাই নয়, ট্রান্সফর্মারবাহী সেভেন এক্সেল লরির ধারণক্ষমতা ৩৫ টন থাকলেও দ্বিগুণেরও বেশি ওজনের ট্রান্সফরমার বহনের ক্ষেত্রে মানা হয়নি ট্রাফিক আইনও।

এনার্জিপ্যাকের সঙ্গে পিজিসিবির চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, অতিরিক্ত ওজন পরিবহনের ক্ষেত্রে সড়ক ও জনপথের সঙ্গে যোগাযোগের কথা এনার্জিপ্যাকের। এমনকি, ট্র্যান্সফরমারটি বহনের সময় সড়ক কিংবা সেতুর ক্ষতি হলে দায়িত্ব নিতে হবে এনার্জিপ্যাককে।

এ বিষয়ে এনার্জিপ্যাকের ম্যানেজার তৌফিক আহমেদ জানান, মহাসড়ক এবং ব্রিজ দিয়ে ৮০ টন ওজনের ট্রান্সফরমার বহনের জন্য একটি সার্ভে করা হয়। আর সেই সার্ভে করেন লরির চালকই। কারণ চালকই তো সড়কের রাজা। আর সেতুটি ৩৬ টনের ওজন ধারণে অক্ষম তা তো কোথাও লেখা ছিল না। এমনটা বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন এই কর্মকর্তা।

ময়মনসিংহ সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন বলেন, সাধারণত অতিরিক্ত ভারবাহী কোনো যানবাহন চলাচল করলে সড়ক ও জনপথকে জানানো হয়। কিন্তু এই ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো তথ্য ছিল না। যারা নিয়েছে কিংবা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি, তারা কেউই এই ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। ইতোপূর্বে দেখেছি এই ধরণের ট্রান্সফরমার পরিবহনের ক্ষেত্রে ডাইভারশন ব্যবহার করেছে। কিন্তু এবার সেটি না করে ঝুঁকি নিয়েই সেতু ব্যবহার করেছে। আমাদের জানালে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারতাম কিন্তু তারা তা করেনি।

পিজিসিবির প্রোজেক্ট-১ এর পিডি আনিসুর রহমান বলেন, এনার্জিপ্যাকের সঙ্গে আমাদের চুক্তিই হচ্ছে ওদের ফ্যাক্টরি থেকে ট্রান্সফরমার ময়মনসিংহ গ্রিডে এনে চালু করে দিবে। সেক্ষেত্রে সওজের অনুমতি নেওয়া কিংবা বাইপাস রোড তৈরি করাসহ যা করার প্রয়োজন সব দায়িত্ব ওই প্রতিষ্ঠানেরই।

সেতু ভেঙে পড়ার পেছনে আইন না মানা এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতাই দায়ী বলে মনে করছেন সচেতন মহল। এই ঘটনায় সরকারের ৩০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে উল্লেখ করে লরি চালককে আসামি করে ত্রিশাল থানায় মামলা করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। কিন্তু শুধু চালককে আসামি করা নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন।

সড়ক সার্ভে করে লরির চালক

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, সড়ক কর্তৃপক্ষের পরিবর্তে ৮০ টনের ট্রান্সফরমার সরবরাহ করতে সড়কটির সার্ভে করেন একজন লরি চালক। আর এতেই ঘটে দুর্ঘটনা। এনার্জিপ্যাক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মহাসড়ক এবং সেতু দিয়ে ৮০ টন ওজনের ট্রান্সফরমার বহনের জন্য একটি সার্ভে করা হয়। আর সেই সার্ভে করেন ওই লরির চালক।

কিন্তু চালক কি সড়ক সার্ভে করতে পারেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন বলেন, চালকের সার্ভে করার কোনো ক্ষমতা নেই। যে প্রতিষ্ঠান এমন ভারী ওজন বহন করবে ওই প্রতিষ্ঠান আমাদের জানাবে। তারপর আমরা তাদের পরামর্শ দিব। এখানে আমাদের না জানিয়ে তাদের আলাদা করে সার্ভে করার কোনো ক্ষমতা নেই।

দুর্ঘটনায় আহতদের খোঁজ নেয়নি কেউ

৮০ টনের ট্রান্সফরমারবাহী লরির ঠিক পেছনেই ছিল একটি যাত্রীবাহী প্রাইভেটকার। চালকসহ পাঁচজন ছিলেন সেই প্রাইভেটকারে। তাদের সবাই আহত হয়েছেন। মো. মিলন শিকদার নামে এক ব্যবসায়ী গুরুতর আহত হয়েছেন। ওইদিন বন্ধুদের নিয়ে নেত্রকোণা বেড়াতে যাচ্ছিলেন তিনি।

মিলন শিকদার বলেন, আমাদের গাড়িটি ওই লরির ৮ থেকে ১০ ফুট পেছনে ছিল। সেতুটি তিনটি অংশে ছিল। লরিটি যে প্রচন্ড ভার বহন করছিল তা সেতুতে উঠার পরই টের পাওয়া যাচ্ছিল। সেতুর প্রথম অংশ পেরিয়ে মাঝখানে যেতেই ভেঙে পড়ে সেতুটি। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রাইভেটকারও পড়ে গিয়ে উল্টে যায়। এরপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর আমার জ্ঞান ফেরে।

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ওই ঘটনায় আমরা আহত হয়েছি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানই আমাদের কোনো খোঁজ নেয়নি। আমরা বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি এ নিয়ে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। যাদের দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতির কারণে এই ঘটনা ঘটেছে, তাদের আমি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।

উবায়দুল হক/এবিএস