টাঙ্গাইলে শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোতে চায়না দুয়ারী বা চায়না জাল ব্যবহার করে মাছ শিকারে ব্যস্ত অসাধু মৎস্য ব্যবসায়ীরা। এতে দেশীয় মাছ বিপন্ন হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়ছে জলজ উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র। যমুনা নদীর কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবৈধ জাল দিয়ে চলে এমন মাছ শিকারের মহোৎসব।

সরেজমিনে দেখা যায়, সদর উপজেলা, ভূঞাপুর, নাগরপুর, গোপালপুর ও কালিহাতী উপজেলায় যমুনা নদীসহ বিভিন্ন নদীতে চায়না জাল পেতে রাখা হয়েছে। বিশেষ করে ভূঞাপুর উপজেলার যমুনা নদীর কয়েক কিলোমিটার এলাকা মৎস্য অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হলেও সেখানে চায়না জাল দিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে। এতে গোবিন্দাসী ঘাটের উত্তর-পশ্চিম হতে শুরু হয়ে গাবসারা ও অর্জূনা ইউনিয়নের বিভিন্নস্থানে জাল পেতে ধরা হচ্ছে দেশীয় প্রজাতি ছোট-বড় সব ধরনের মাছ।

ভূঞাপুর উপজেলার খানুরবাড়ি হালদার পাড়ার রবীন্দ্র চন্দ্র হালদার (৫০)। বাপ-দাদার পেশাটাকে ধরে রেখে নিয়মিত পাশের যমুনা নদীতে মাছ ধরতে যান তিনি। তবে তার জালে আর আগের মতো মাছ উঠে না। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত নদীতে দুইবার জাল ফেলতে পারেন। তার দলে আরও ৪ জন রয়েছেন। তবে সপ্তাহ খানেক ধরে তেমন মাছ পাচ্ছেন না।

রবীন্দ্র চন্দ্র হালদার বলেন, জেলের ঘরে জন্ম আমাদের। মাছ ধরা ছাড়া কোনো কর্ম জানা নেই। নদীতে মাছ পাওয়া যায় না আগের মতো। নদীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নিষিদ্ধ চায়না জাল। পোনা থেকে শুরু করে ছোট বড় কোনো মাছই ছাড়া পায় না চায়না জাল থেকে। অবৈধ এই জালগুলো বন্ধ না হলে আগামী প্রজন্ম দেশীয় প্রজাতির মাছের নাম ভুলে যাবে।

জানা গেছে, জেলার পাঁচটি উপজেলায় বিভিন্ন নদীতে প্রায় ১০ হাজারের মত চায়না জাল বা চায়না দুয়ারী জাল দিয়ে নির্বিচারে মাছ শিকার করা হচ্ছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী, গাবসারা, অজূর্না ও নিকরাইলের কিছু অংশের যমুনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ৩ হাজারের অধিক চায়না জাল বিছানো রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি কম থাকা, মাঝ নদীতে খন্ড খন্ডভাবে চর জাগায় চায়না জালের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু নদীগুলোতেই নয়, খাল ও বিলে একই পন্থায় মাছ ধরা হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোবিন্দাসীর চায়না জাল দিয়ে মাছ শিকার করা একজন বলেন, ৪টি লোহার ফ্রেমের ভেতর জাল দিয়ে তৈরি করা হয় চায়না জাল। নদীতে বিভিন্ন পয়েন্টে ২০টি চায়না জাল পেতেছি। আমার মত অনেকেই এলাকা ভাগ করে চায়না জাল দিয়ে মাছ শিকার করছে। বিকেলে পেতে রাখা হয়, রাতের বেলা একবার এবং ভোরের দিকে একবার জাল তুলে মাছগুলো সংগ্রহ করি। পরে সেই তাজা মাছগুলো স্থানীয় বাজারে বেশি দামে বিক্রি করা হয়।  

মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানান, চায়না জাল বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়ায় স্থানীয় জাল বিক্রেতাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জাল ক্রয় করা হয়। মাঝে মাঝে নদীতে অভিযান হলে কয়েকটি জাল পুড়িয়ে দিলেও অধিকাংশ জাল দালালের মাধ্যমের ফেরত নেওয়া হয়।

মৎস্য বিশেষজ্ঞ মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর ড. মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ফেব্রুয়ারি হতে এপ্রিল পর্যন্ত মা মাছ ডিম ছেড়েছে। ডিমগুলো এখন কিছুটা মাছে রুপান্তরিত হচ্ছে। অনেক জলাশয়ে অল্প পরিমাণে পানি থাকে এবং সেখানে মাছগুলো ডিম ছাড়ে। এই সুযোগে অসাধু যারা রয়েছে অল্প পরিশ্রমে অনেক মাছ ধরতে পারবে তারা এই অবৈধ জাল ব্যবহার করে সব মাছ ধরে নিয়ে যায়। অথচ নদীতে যখন পানি আসবে তখন এই মাছগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেত নদীসহ বিভিন্ন খাল-বিল জলাশয়ে। অবৈধ চায়না জাল বা কারেন্ট জাল যারা ব্যবহার করছে তাদেরকে কঠোর শাস্তি আওতায় আনা দরকার।

তিনি আরও বলেন, শুধু তাই নয় যারা এই অবৈধ জাল আমদানি করছে এবং বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া জেলা-থানা মৎস্য কর্মকর্তাসহ প্রত্যেক জায়গায় সরকারের লোকজন রয়েছে। তাদের নজরদারি বাড়ানোসহ আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিতদের কাজে লাগাতে পারলে এটি বন্ধ করা সম্ভব হবে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, নদীতে পানি আসতে শুরু করায় অবৈধ চায়না জালগুলোর ব্যবহার বাড়ছে। অবৈধ চায়না জাল বন্ধে বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণা করা হচ্ছে। এছাড়া মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করা হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে যাতে নদীতে অবৈধ চায়না জাল ব্যবহার না করা হয়।

তিনি আরও বলেন, চায়না জাল একটা ফিক্সড ইঞ্জিন বলা হয়। এই জালে ছোট-বড় সব মাছই ধরা পড়ে। বিশেষ করে দেশীয় প্রজাতির মাছগুলো বেশি আটকে জালে। এটি জলজ উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। চায়না জাল খাল ও বিলে বেশি ব্যবহার করা হয়। নদীর কিনার বা চর এলাকায় এই জালটি ব্যবহার হয়।

অভিজিৎ ঘোষ/এবিএস