পাটগ্রামে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ হলরুমে তদন্তকাজে জেলা প্রশাসক আবু জাফর

রংপুরে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক সাহিদুন্নবী জুয়েলকে (৫০) পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুন নাহারের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা তদন্ত শুরু করেছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি)।

বৃহস্পতিবার (২৫ মার্চ) ঘটনাস্থল বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ হলরুমে দিনভর তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসক আবু জাফর।

এর আগে তদন্তকাজে সহায়তার জন্য গত রোববার (২১ মার্চ) গণবিজ্ঞাপ্তি জারি করেন জেলা প্রশাসক। যা ওই এলাকায় ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়।

গত বছরের ২৯ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) বিকেলে পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে। নিহত যুবক আবু ইউনুস মো. সাহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়ার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে।

সাহিদুন্নবী জুয়েল

তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক ছাত্র। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ায় কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি।

গণবিজ্ঞাপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে গত বছরের ২৯ অক্টোবর বিকেলে কোরআন অবমাননার অভিযোগে আবু ইউনুস মো. সাহিদুন্নবী জুয়েল নামে এক যুবককে গণপিটুনিতে হত্যা ও পরে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। 

এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা তৎকালীন পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুন নাহারের (পরিচিতি নম্বর ১৭৪৬৭) কর্তব্যে অবহেলা ও অদক্ষতার অভিযোগের তদন্ত করা হবে। তাই বৃহস্পতিবার (২৫ মার্চ) সকাল ১১টায় ওই দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত সর্বসাধারণকে উপস্থিত থেকে তদন্তকাজে সহায়তা করতে গণবিজ্ঞাপ্তি জারি করেন জেলা প্রশাসক আবু জাফর।

গণবিজ্ঞাপ্তি মোতাবেক বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ হলরুমে তদন্তকাজ শুরু করেন জেলা প্রশাসক আবু জাফর। এ সময় তিনি ১৫ জনের লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করেন তিনি।

তদন্ত শেষে জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, মন্ত্রপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক এটি একটি প্রশাসনিক তদন্ত। যথা সময়ে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

উল্লেখ্য, ২৯ অক্টোবর বিকেলে সুলতান রুবায়াত সুমন নামে একজনকে সঙ্গে নিয়ে বুড়িমারী বেড়াতে আসেন সাহিদুন্নবী জুয়েল। বিকেলে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন তারা। নামাজ শেষে পাঠ করার জন্য মসজিদের সানসেটে রাখা কোরআন শরিফ নামাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কয়েকটি কোরআন পড়ে যায়।

এরপর আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সন্দেহবশত জুয়েল ও সুলতান রুবায়াত সুমনকে পাশের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখেন। খবর পেয়ে পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ওসি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে যান।

একপর্যায়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুজব ছড়িয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা পরিষদ ভবনের দরজা-জানালা ভেঙে প্রশাসনের কাছ থেকে জুয়েলকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন। পরে মরদেহ টেনে পাটগ্রাম-বুড়িমারী মহাসড়কে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন স্থানীয়রা। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন।

সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধা থানা পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দফায় দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। একসময় বিক্ষুব্ধ জনতার ছোড়া ইট-পাথরের আঘাতে পাটগ্রাম থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন্ত কুমার মহন্তসহ ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন।

পরে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ১৭ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। রাত সাড়ে ১০টার দিকে লালমনিরহাটের ডিসি আবু জাফর ও এসপি আবিদা সুলতানা অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। নিহত জুয়েলের সঙ্গী সুমনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।

জুয়েলের চাচাতো ভাই সাইফুল আলম, পাটগ্রাম থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে হত্যাসহ পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনাস্থলের ভিডিও দেখে আসামি শনাক্ত করে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৭ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতাররা সবাই বুড়িমারী এলাকার বাসিন্দা।

এর আগে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার কোনো সত্যতা পায়নি। গুজব ছড়িয়ে জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন দুটি তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

নিয়াজ আহমেদ সিপন/এমএসআর