সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের চাঞ্চল্যকর বিউটি হত্যার পাঁচ বছর পর ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এ ঘটনায় যুক্ত থাকা চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। বাকি একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ২০২১ সালে।

সোমবার (২৯ মে) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সিরাজগঞ্জ পিবিআইয়ের কার্যালয়ের হল রুমে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার (এসপি) রেজাউল করিম। তাকে ৫০ হাজার টাকা চুক্তি দিয়ে হত্যা করা হয় বলে জানান এসপি।

নিহত বিউটি খাতুন জেলার এনায়েতপুর থানার ব্রাহ্মণগ্রাম গ্রামের মো. সাচ্চু মিয়ার মেয়ে। এ ঘটনায় সাচ্চু মিয়া বাদী হয়ে ২০১৮ সালের ১৪ মে এনায়েতপুর থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- এনায়েতপুর থানার ব্রাহ্মণগ্রামের মৃত আমির হোসেনের ছেলে স্বপন ব্যাপারী (৩৭), মৃত জসিম উদ্দিনের ছেলে মো. মমিন (৫৫), মমিনের স্ত্রী আনু বেগম (৪০) ও ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে ওমর ফারুককে (২৮) গ্রেপ্তার করা হয়।

পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার রেজাউল করিম বলেন, ২০১৮ সালের ১৩ মে রাতে বিউটি খাতুন তার নিজ ঘরে ঘুমিয়ে পড়েন। এ সময় বিউটির মা কোমেলা খাতুন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে দেখেন তার মেয়ের ঘরের দরজা খোলা। সেই সময় বিউটিকে নাম ধরে ডাকলে কোনো সাড়া-শব্দ না করায় মা তার শরীরে হাত দিয়ে ডাকাডাকি করেন। পরে চিৎকার দিলে বিউটির পরিবারের সদস্যরা ঘরের আলো জ্বালিয়ে দেখেন বিউটি মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। পরিবারের লোকজনের চিৎকারে স্থানীয় লোকজন এসে থানা পুলিশকে খবর দেন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠায়। পরে বিউটির বাবা সাচ্চু মিয়া বাদী হয়ে এনায়েতপুর থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।

মামলাটি থানা পুলিশের পাশাপাশি ছায়া তদন্ত করতে থাকে সিরাজগঞ্জ পিবিআই। মামলাটি তদন্তের প্রায় দুই বছর পরে বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স মামলাটি পিবিআইকে তদন্ত করার নির্দেশ দেন। 

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে সিরাজগঞ্জ পিবিআই মামলাটির তদন্ত শুরু করে। দীর্ঘদিন তদন্তের একপর্যায়ে গত ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে ওমর ফারুককে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। এরপর তদন্তে প্রমাণ পাওয়ায় চলতি বছরের ২৩ ও ২৫ মে রাতে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে আটক করে পিবিআই। পরে গ্রেপ্তারকৃতরা হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা জানিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। 

হত্যার বিবরণে পুলিশ সুপার জানান, ২০১৪ সালে এনায়েতপুরের কোচগাঁও গ্রামের আব্দুল্লাহর সঙ্গে বিউটি খাতুনের বিয়ে হয়। বিয়ের তিন বছর পরে স্বামীর সঙ্গে তালাক হয়। বিউটি বাবার বাড়িতে থাকা অবস্থায় প্রতিবেশী ওমর ফারুকের সঙ্গে মোবাইলে কথাবার্তা বলতো। একপর্যায়ে ফারুকের প্রেমের প্রস্তাব না করে বিউটি। এর মধ্যে বিউটির ছোট বোন আলোমতির সঙ্গে তার স্বামীর পরিবারের ঝামেলা হয়। পরে বিউটির বাবা সাচ্চু মিয়া তাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের স্বপন ব্যাপারীকে বিষয়টি সমাধান করার জন্য অনুরোধ করেন। স্বপনের মাধ্যমে বিউটির ছোট বোন আলোমতির স্বামীর বাড়ির সমস্যার সমাধান হওয়ায় বিউটির পরিবারের সঙ্গে স্বপনের সু-সম্পর্ক তৈরি হয়। পাশাপাশি বিউটির ছোট খালা আন্না মাদক ব্যবসা করায় এবং স্বপন মাদকসেবী হওয়ায় সে বিউটির মোবাইল দিয়ে স্বপনের সঙ্গে মাঝে মধ্যে কথা বলত।

অপরদিকে স্বপন মাদকসেবী হওয়ায় মাঝে মধ্যে আন্নার বাড়িতে যাওয়া-আসা করত এবং মাদক সেবন করত। সেই সুবাদে বিউটির সঙ্গে স্বপনের দেখা সাক্ষাৎ হতো এবং মোবাইলে কথাবার্তা হতো। স্বপন বিউটির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু স্বপন সরাসরি বিউটিকে প্রস্তাব দিতে না পেরে আন্নাকে জানান। পরবর্তীতে স্বপন আন্নার মাধ্যমে বিউটির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করেন। আন্নার বাড়িতে স্বপন নিয়মিত বিউটির সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও মেলামেশা করতেন। বিউটির সঙ্গে স্বপনের ২ মাস সম্পর্ক চলার পর বিউটি বিয়ে করার জন্য স্বপনকে চাপ দেন। স্বপন বিবাহিত হওয়ায় বিউটিকে বিয়ে করতে রাজি নয় বলে জানান। বিউটি স্বপনকে জানান- তিনি অন্তঃসত্ত্বা।

পরবর্তীতে বিউটি স্বপনের ওপর বিয়ের জন্য আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করলে স্বপন কী করবে তা ভেবে না পেয়ে ঘটনার ১০/১২ দিন আগে প্রতিবেশী ওমর ফারুককে ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন এবং একপর্যায়ে স্বপন বিউটিকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। ওমর ফারুককে সঙ্গে থাকতে বলেন। কিন্তু ওমর ফারুক রাজি না হলে স্বপন তাকে ভয়ভীতি দেখান। স্বপন বিউটির সঙ্গে ওমর ফারুকের পূর্বের সম্পর্ক নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে হত্যার পরিকল্পনায় সঙ্গে নেয়।

পরে স্বপন বিউটির ছোট খালা আন্নার কাছে বিউটিকে হত্যা করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আন্না তার নিজের ভাগনিকে হত্যা করতে রাজি না হলে স্বপন তাকে টাকার লোভ দেখিয়ে রাজি করায়। পরে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে আন্নার সঙ্গে বিউটিকে হত্যা করার চুক্তি হয়। তাৎক্ষণিক স্বপন নিজে ২০ হাজার ও ওমর ফারুকের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে আন্নাকে দেন। 

তখন বিউটির ছোট খালা তার আপন মেজো বোন আনু বেগমকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে বিউটিকে হত্যা করতে সহায়তা করতে বলেন। পরবর্তীতে আনু বেগম তার স্বামী মোমিনের সঙ্গে কথা বলে তাকে রাজি করায়। তাদের পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক গত ২০১৮ সালের ১৩ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিউটিদের বাড়ির পাশে সবাই একত্র হন। পরে স্বপন, ওমর ফারুক, আনু, আন্না ও মোমিন বিউটির ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত অবস্থায় বিউটিকে হাত-পা ও মাথা চেপে ধরে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে কৌশলে পালিয়ে যান। 

শুভ কুমার ঘোষ/আরএআর