উত্তরের পাঁচ জেলা দেশের অন্যতম বৃহত্তম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। চা উৎপাদনের দিক থেকে সর্বশেষ গত দুই অর্থবছরে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে উত্তরাঞ্চল। চা উৎপাদনে প্রতি বছর উত্তরাঞ্চল একের পর এক রেকর্ড করছে। সমতলের চা ঘিরে তৈরি হয়েছে অপার সম্ভাবনা।

তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি চাষিরা কাঁচা পাতার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় সংকট দেখা দিচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ক্ষুদ্র চাষিরা। এ অবস্থায় চা-শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সংকট নিরসনের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। 

বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত মৌসুমে উত্তরের পাঁচ জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাটের সমতল ভূমিতে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার ২২৬ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। যা আগের মৌসুমের (২০২১) চেয়ে ৩২ লাখ ১৯ হাজার ২২৬ কেজি বেশি। উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমিতে ২০১৭ সালে ৫৪ লাখ ৪৬ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়। এরপর ২০১৮ সালে ৮৪ লাখ ৬৭ হাজার কেজি, ২০১৯ সালে ৯৫ লাখ ৯৯ হাজার কেজি, ২০২০ সালে ১ কোটি ৩ লাখ কেজি, ২০২১ সালে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে।

২০০০ সালে বেশ কয়েকটি কোম্পানি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় চা-বাগান গড়ে তোলে। ২০০৭ সালে লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও, ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় চা চাষ শুরু হয়। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলায় নিবন্ধিত ৯টি ও অনিবন্ধিত ২১টি বড় চা-বাগান (২৫ একরের বেশি) আছে। এ ছাড়া ২ হাজার ৫৩টি নিবন্ধিত ও ৬ হাজার ৩০২টি অনিবন্ধিত ছোট চা-বাগান (২৫ একরের কম) আছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার ৭৯ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র চা চাষি আছেন ৮ হাজার ৩৫৫ জন।

উত্তরাঞ্চলে এখন পর্যন্ত অনুমোদিত ৫২টি চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা আছে। এর মধ্যে পঞ্চগড়ে ২৫টি ও ঠাকুরগাঁওয়ে একটি কারখানা সচল।

চাষিদের অভিযোগ, চা বাগান ঘিরে কারখানা বাড়লেও বাড়ছে না চা পাতার দাম। চা শিল্প ঘিরে তৈরি হয়েছে এক ধরনের সিন্ডিকেট। কয়েক বছর ধরেই পাচ্ছেন না উৎপাদিত কাঁচা চা পাতার ন্যায্য দাম। চলতি মৌসুমে চা পাতা কারখানাগুলো যে দামে কিনছে, তাতে করে তাদের উৎপাদন খরচও উঠছে না। বছরের শুরুতেই গুনতে হচ্ছে লোকসান।

বাগান মালিক মো. মুরাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ২০২০ সাল থেকে এই চা বাগানে কাজ শুরু করি। প্রায়ই দুই একর জমির ওপরে যখন বাগান করা হয় তখন চায়ের দাম ভালো ছিল। চায়ের দাম তখন ৩৬-৪০ টাকা ছিল। কিন্তু বর্তমান যে অবস্থা সব কিছুর দাম ঊর্ধ্বগতি হলেও চায়ের দাম অনেক কম। বলতে গেলে চা এখন ফ্রি দেওয়া হচ্ছে। কেজি প্রতি দাম দিচ্ছে ১২-১৩ টাকা। যেখানে আমাদের ১ কেজি চা উৎপাদন করতে খরচ হয়েছে ১৫-১৬ টাকা। 

তিনি বলেন, বর্তমানে চা-বাগান করা আমার সবচেয়ে বড় ভুল। কারণ এটাতে কোনো লাভ নেই। সবার কাছে ঋণী হয়ে রয়েছি। চা বাগানে যেসব কীটনাশক লাগে সেই কীটনাশকের দোকানদারের কাছে আমি ঋণী। এই বাগানে যারা কাজ করে থাকে তাদের কাছে ঋণী। এই চা বাগান করে আমি চতুর্দিক থেকে ঋণী। আবার যারা পাতা নেয় ফ্যাক্টরিতে তারা সঠিক সময়ে পাতা নেয় না। 

চা শ্রমিক মালেক বলেন,  বর্তমানে চায়ের দাম খুবই কম। মালিকরা চায়ের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। আমাদেরকে দুই মাস থেকে বেতন দিতে পারতেছে না। বাড়িতে লোক অনাহারে আছে। এখন যদি চায়ের দামটা বৃদ্ধি পায় তো মহাজন লাভবান হলে আমাদের বেতন দিতে পারবেন। আমি দুই মাস থেকে বেতন পাচ্ছি না, বাসায় টাকা দিতে পারছি না।

চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালে পঞ্চগড়ে বাণিজ্যিকভাবে চা শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। গত দুই দশকে বদলে যায় প্রেক্ষাপট। এক সময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি হয়ে উঠে সবুজ চা বাগান। সবুজ পাতায় জেগে নতুন সম্ভাবনা। চা উৎপাদনে সিলেটের পর দ্বিতীয় অঞ্চল হয়ে উঠেছে উত্তরবঙ্গ। 

ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, চা চাষ বেড়েছে। কিন্তু বর্তমানে চা চাষিরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। ফলে অনেকেই চা-বাগান কেটে ফেলছেন।

আরএআর