মেহেদী হাসান

‘ভোরে রাজশাহীতে যাওয়ার সময়ে মা বলেছিল, রাতের মধ্যে ফিরে আসবে। কিন্তু এটা কী হলো, এখন আমার মা কোথায়? আব্বার মতো মা তো আমাকে ছেড়ে গেল। আমাকে এখন কে বলবে? “তুই ভালো করে পড়ালেখা করিস, বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে হবে।” আমার যে আর কেউ থাকল না। খালা-খালুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে মা আমাকে ছেড়ে গেল।’

থেমে থেমে এসব কথা বলে বাকরুদ্ধ হয়ে চাপাকান্না করছিলেন মেহেদী হাসান তুবা। শুক্রবার (২৬ মার্চ) রাজশাহীর কাটাখালীতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো কামরুন্নাহারের একমাত্র ছেলে।

মেহেদী হাসান তুবা (২০) এবার উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার। শুক্রবার (২৬ মার্চ) ভোরে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়াতে মায়ের সঙ্গে রাজশাহীতে যাওয়া হয়নি তার। সেই কথা মনে করে বিলাপ করছেন আর বার বার অবরুদ্ধ হয়ে কী যেন ভাবছিলেন মেহেদী।

মেহেদীর বাবা শাহজাহান মন্ডল তোতা ২০০০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ঠিক ২ দশক পর তার বাবার মতোই সড়কে প্রাণ গেল মা কামরুন্নাহারের। এখন বাবার পর মাকে হারিয়ে শোকে বাকরুদ্ধ মেহেদী। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তার আশপাশে থাকা মানুষদের মুখের দিকে চেয়ে দেখছে। যেন কান্নাটাও ভুলে গেছে।

ঢাকা পোস্টকে মেহেদী হাসান বলেন, ‘জীবনে কী পেলাম? আমার যখন আড়াই মাস বয়স তখন আব্বা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। আব্বার আদর স্নেহ ভালোবাসাবঞ্চিত হয়েছি। মা আমাকে আগলে রেখে বড় করেছে। আমাকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল। আমার খালা-খালুও আমাকে খুব ভালোবাসতো। আজ তারা কেউই বেঁচে নেই। সবাই আমার আব্বার মতোই সড়কে মারা গেল। ঘুম থেকে উঠতে দেরিতে শুধু আমিই যেন প্রাণে বেঁচে গেলাম। মায়ের সঙ্গে মাইক্রোবাসে গেলেই তো ভালো হতো।’

শুক্রবার (২৬ মার্চ) বেলা পৌনে ২টার দিকে রাজশাহীর কাটাখালীতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান কামরুন্নাহার। তিনি রংপুরের পীরগঞ্জের চৈত্রকোল ইউনিয়নের বড় রাজারামপুর গ্রামের আব্দুল করিম সরকারের মেয়ে। তার স্বামী শাহজাহান মন্ডল তোতার ২০ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে।

মেহেদীর ছোট খালা শামসুন্নাহার (৩২) ও খালু সালাহউদ্দিনের (৩৮) সঙ্গে কামরুন্নাহারও রাজশাহীতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। কাটাখালীতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় কামরুন্নাহারসহ (৩৭) তার ছোট বোন, বোনের স্বামী এবং ৮ বছরের ছেলে সাজিদ ও আঠারো মাসের মেয়ে সাফা প্রাণ হারান।

নিহত কামরুন্নাহারের চাচাতো ভাই নুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, শুক্রবার সকালে (২৬ মার্চ) উপজেলা সদরের রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ীর কালো রংয়ের মাইক্রোবাস নিয়ে সেখানকার চারটি পরিবারের ১৮ জন রাজশাহীতে বেড়ানোর উদ্দেশে রওনা দেন।

মাইক্রোবাসটি রাজশাহীর কাটাখালী থানার সামনে সড়কে পৌঁছলে বিপরীত দিক থেকে আসা হানিফ পরিবহনের একটি বাস সামনে থেকে ধাক্কা দেয়। এতে ওই মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে যায়। এতে মাইক্রোবাসে থাকা সবাই দগ্ধ হয়ে মারা যান। শুধু প্রাণে বেঁচে যান চালক হানিফ মিয়া। তবে তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক।

পীরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরেস চন্দ্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রাজশাহীর ওই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত সতেরো জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। লাশ দ্রুত পীরগঞ্জে আনার চেষ্টা চলছে। দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসে চালকসহ ১৮ জন যাত্রী ছিলেন। দুর্ঘটনার পর চালক হানিফ হোসেনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমএসআর