আগুনে নিভল ফুল মিয়ার সংসার
ফুল মিয়াসহ (বাঁয়ে) পরিবারের সদস্যরা
‘একটা বাসের ধাক্কায় মাইক্রোতে আগুন ধরে সব শেষ হয়ে গেল। ভাইয়ের গোছানো সংসারটা আর থাকল না। কোনো দিনও ভাবী নাই, সবাই একসঙ্গে মারা যাবে। আল্লাহ আমাদেরকে এ কেমন শাস্তি দিল। ভাই-ভাবির সঙ্গে অবুঝ তিনটা বাচ্চাকেও কেড়ে নিল। এভাবে সবাই আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেল। এটা কি সহ্য করার মতো? আমাদের পুরো সংসারই এখন শেষ।’
রাজশাহীতে মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া বড় ভাই, ভাবি ও তাদের তিন ছেলে-মেয়ের লাশের অপেক্ষায় থাকা সুজন মণ্ডল কাঁদতে কাঁদতে ঢাকা পোস্টকে এসব কথা বলছিলেন।
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার (২৬ মার্চ) দুপুর পৌনে ২টার দিকে রাজশাহীর কাটাখালীতে বাস-মাইক্রোবাস-লেগুনার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে যায়। মাইক্রোবাসে থাকা সবাই দগ্ধ হয়ে মারা যান। শুধু প্রাণে বেঁচে যান চালক হানিফ মিয়া। তবে তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
ওই দুর্ঘটনায় সুজন মণ্ডলের বড় ভাই ফুল মিয়া (৪০), ভাবি নাজমা বেগম (৩৫), ভাতিজি সাবিয়া (৪), সুমাইয়া (৮) ও ভাতিজা ফয়সাল (১৩) আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। তারা সবাই রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের বড়মজিদপুরের বাসিন্দা। ফুল মিয়া পীরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে মোটরপার্টসের ব্যবসা করতেন।
বিজ্ঞাপন
বিকেলে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নিহতদের পরিবারসহ চার ইউনিয়নের গ্রামজুড়ে নেমে আসে শোকের মাতম। ওই দুর্ঘটনায় ফুল মিয়ার পরিবারের পাঁচজন ছাড়াও আরও তিন পরিবারের এগারো এবং আরেক পরিবারের একজন মারা গেছেন। একসঙ্গে ১৭ জনের মর্মান্তিক এই মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ গ্রামবাসী এখন লাশের অপেক্ষায় রয়েছেন।
পরিবারের উপার্জনক্ষম ফুল মিয়াকে অকালে হারিয়ে শোকে কাতর মা সাহিদা খাতুন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে তার ছেলে-ছেলের বউ আর নাতি-নাতনি বেঁচে নেই।
একটা পুরোনো অ্যালবামের কিছু ছবি হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন ফুল মিয়ার মা। তার আহাজারি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন গ্রামের সাধারণ মানুষরাও।
নিহত ফুল মিয়ার ছোট ভাই সুজন মণ্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে আমাদের পরিবারে উপার্জনক্ষম আর কেউ থাকল না। আগে বাবাকে হারিয়েছি। আজ ভাইকে হারিয়ে যেন সব কিছুই হারালাম। শুক্রবার ভোরে ভাই-ভাবিসহ বাচ্চাদের দেখলাম বেড়াতে যেতে। এখন শুনছি তারা কেউ বেঁচে নেই। পিকনিক শেষে একটা মাজার জিয়ারত করে তাদের সবার বাড়ি ফেরার কথা ছিল।’
বড়মজিদপুরের বাসিন্দা বাবুল মিয়া বলেন, ‘পীরগঞ্জে একসঙ্গে এতগুলো মানুষের মৃত্যু, এর আগে কখনো হয়নি। সবাই নাকি আগুনে পুড়ে মরে গেছেন। এরকম মৃত্যু যেন আর কারও না হয়। এই শোক সহ্য করা খুব কষ্টের।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশেষ করে ফুল মিয়ার পরিবারের কথা ভেবে বেশি কষ্ট হচ্ছে। তাদের একটা গোছানো সংসার শেষ হয়ে গেল। পরিবারটাতে আয়-রোজগার করার মতো এখন ছোট ভাই ছাড়া আর কেউ নেই। তাদেরকে সান্ত্বনা দেবার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি।’
রামনাথপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মাহফুজার রহমান মাফু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মাইক্রোবাসে থাকা সবার মৃত্যু হয়েছে বলে শুনেছি। তবে আমার ইউনিয়নের বড়মজিদপুরের ফুল মিয়াসহ তার পরিবারের পাঁচজন মারা গেছেন। আমি তাদের মরদেহ আনতে রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা হয়েছি।’
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমএসআর