নজর কাড়ছে চাঁদপুরের যুবরাজ-কালা মানিক
কোরবানি ঈদের বাকি আর মাত্র ৯ দিন। প্রতি বছর ঈদের আগ মুহূর্তে সারাদেশে নানা আকার ও দামের কারণে আলোচনায় আসে বাহারি নামের গরু। এবারও সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে চাঁদপুরের ‘যুবরাজ’ ও ‘কালা মানিক’। বিশাল আকারের গরু দুটি প্রস্তুত করেছেন চাঁদপুর সদরের খামারি পারভীন ইসলাম ও ফরিদগঞ্জের আব্দুল খায়ের সেন্টু মিয়া।
গরু দুটি জেলার সবচেয়ে বড় গরু বলে দাবি এই দুই খামারির। সুঠাম দেহের অধিকারী গরু দুটির গায়ের রং কুচকুচে কালো। তারা গরু দুটির দাম হাঁকাচ্ছেন অর্ধকোটি টাকা। গরু দুটিকে দেখতে তাদের বাড়িতে আসছেন দর্শনার্থী ও ক্রেতারা। গত বছর ক্রেতা সংকটের কারণে বিক্রি করতে না পারলেও এবার গরু দুটি ক্রেতার হাতে তুলে দিতে চান এই দুই খামারি।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, যুবরাজের মালিক হাজীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান পারভীন ইসলাম। তিনি ২০০৫ সালে চাঁদপুর সদর উপজেলার শাহমাহমুদপুর ইউনিয়নের মান্দারী গ্রামের চেয়ারম্যান মার্কেট এলাকায় শখের বসে দুটি গরু দিয়ে খামার শুরু করেন। বর্তমানে তার খামারে ছোটবড় ১০৫টি গরু রয়েছে। তার খামারের ফ্রিজিয়ান জাতের গাভির মাধ্যমে যুবরাজের জন্ম। তার বয়স এখন তিন বছর। এবার কোরবানির ঈদে বিক্রি করার জন্য ৫১টি গরু প্রস্তুত করেছে। এদের মধ্যে যুবরাজ আকার এবং ওজনে সব থেকে বড়। এই গরুটিকে জেলার সবচেয়ে বড় বলে দাবি করেন এ নারী খামারি।
যুবরাজ নামের গরুটির বর্তমান ওজন (২ হাজার কেজি ) ৫০ মণ। লম্বায় ১০ ফুট ও উচ্চতায় ৮ ফুট। গরুটি জেলার সবচেয়ে বড় চমক বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
পারভীন ইসলাম বলেন, যুবরাজ গরুটি আমার অনেক সখের। এটি শখ করে লালন-পালন করছি। গত বছর কোরবানির হাটে যুবরাজকে তুলেছিলাম। ন্যায্য দাম না পাওয়ায় বিক্রি করিনি। এবার যেন ন্যায্য দাম পাই সবাই দোয়া করবেন। গরুটি ২৫ লাখ টাকা হলে বিক্রি করব। তার পেছনে প্রতিদিন এক হাজার টাকা ব্যয় হয়। কোরবানির ঈদে বিক্রি করার জন্য ৫১টি গরু প্রস্তুত করেছি। তাদের মধ্যে যুবরাজই সেরা। আমি হাট-বাজারে গরু বিক্রি করব না। গরুগুলো আমার বাড়ির সামনে প্রদর্শন করব। এখানে হাসিল ছাড়া ক্রেতারা গরু ক্রয় করতে পারবেন।
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও বলেন, যুবরাজের নিয়মিত খাবারের তালিকায় রয়েছে খড়, ভুসি, খেসারি, মসুরি, হালকা ফিড, গমের ভুসিসহ অন্যান্য সাধারণ মাঠের ঘাস পাতা। সামান্য পরিমাণ ফিড দেই। এছাড়াও দুই বেলা স্যালাইন খাওয়ানো হয়। আদর-যত্নে যুবরাজের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খেয়াল রাখছেন পরিবারের সবাই। সারাক্ষণ মাথার ওপরে ফ্যান চালানো হয়। দৈনিক দুই বার গোসল করানো হয়।
পারভীন ইসলামের ছেলে ফাহাদ ইসলাম জানান, গরুটির নাম যুবরাজ রাখার কারণ হচ্ছে জন্মের পর থেকে তার চাল-চালন ও আচরণে রাজকীয় ভাব দেখা গেছে। যার কারণেই তার নাম যুবরাজ দেওয়া হয়েছে। আমরা তার পেছনে অনেক সময় ব্যয় করি।
গরুটি দেখতে এসেছেন জাহাঙ্গীর আলম নামে এক ক্রেতা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গরুর খামার দেখতে আসলাম। গরুটি দেখে ভালো লাগলো। আমাদের পছন্দ হয়েছে। আমরা ৪-৫ জন মিলে গরুটি কিনে নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছি। এখানে আমার আসার মূল কারণ হচ্ছে এ রকম একটা খামার তৈরি করার ইচ্ছা আছে। এ জন্যই খামারে আসলাম। এতো বড় গরু এর আগে চাঁদপুরে দেখিনি। আশা করছি এর মালিক ন্যায্যমূল্য পাবেন।
চাঁদপুর সদর উপজেলার শাহমাহমুদপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান স্বপন মাহমুদ জানান, সবুজ বাংলা ডেইরি ফার্মের উদ্যোক্তা একজন নারী। এখানে তিনি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে আসছেন। তার এখানে যুবরাজ নামে একটি গরু রয়েছে। গরুটি গত বছর তারা বিক্রি করার জন্য বাজারে তোলেন। কিন্তু ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় বিক্রি করেননি। এবারও তিনি গরুটি বিক্রি করার জন্য প্রস্তুত করেছেন। আমার মনে হচ্ছে এটি জেলার সবচেয়ে বড় গরু।
এদিকে কালা মানিক নামের বিশাল আকৃতির গরুটি ফরিদগঞ্জ উপজেলার পাটওয়ারী বাজারের মায়ের দোয়া হালিমা ডেইরি ফার্মের মালিক প্রবাসী সেন্টু মিয়া লালন-পালন করছেন। গরুটি চার বছর আগে সাড়ে তিন লাখ টাকায় কেনেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ান-ফ্রিজিয়ান ক্রস জাতের গরুটি লম্বায় ১০ ফুট, উচ্চতায় প্রায় ৮ ফুট। বর্তমানে তার ওজন প্রায় ৪৫ মণ। এর পেছনে ব্যয় হয়েছে ২০ লাখ টাকা।
গত বছর ক্রেতা সংকটে কালা মানিক বিক্রি হয়নি। তাই এবারও কালা মানিককে ক্রেতার হাতে তুলে দিতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন খামারি সেন্টু মিয়া। গরুটি বিশাল আকারের হওয়ায় প্রতিদিন লোকজন তাকে দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে ভিড় করছে। দাম হাঁকা হচ্ছে ২৫ লাখ টাকা।
কালা মানিকের পরিচর্যাকারী রেজাউল করিম জানান, গরুটিকে সব সময় দেশীয় জাতের খাবার খাওয়াই। কোনো রকম ফরমালিন জাতীয় জিনিস এবং কেমিক্যাল জাতীয় জিনিস খাওয়াই না। গত বছর ঢাকার একটি বাজারে গরুটি ১২ লাখ টাকা বলেছিল, বিক্রি করিনি। এ বছর গরুটির ওজন বেড়ে গেছে। তাই গরুটি ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি করার পরিকল্পনা করেছি। তবে এক দামে তো আর বিক্রি হয় না। কিছু কমিয়ে রাখব। কোনো ব্যক্তি গরুটি ক্রয়ের জন্য যোগাযোগ করলে আমরা সরাসরি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করব। এছাড়াও এ খামারে প্রায় ৭৫টি গরু রয়েছে। এবারের ঈদে বিক্রির জন্য ৭টি গরু প্রস্তুত করা হয়েছে। কালা মানিকের গায়ের রং কুচকুচে কালো। তাই তার নাম কালা মানিক।
স্থানীয় বাসিন্দা অধ্যক্ষ মাওলানা দেলোয়ার হোসেন মল্লিক, ওষুধ ব্যবসায়ী ডা. রফিক জানান, গরুটির মান অনেক ভালো। এ গরু ওজন এবং গুণগত মানের দিকে প্রথম সারির। এ গরুটির ন্যায্য দাম না পেলে মালিক অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। গরুটি দেখলে আপনাদের পছন্দ হবে।
আনোয়ার হোসেন নামে আরেকজন জানান, আমি অনেক খামারে ঘুরে ঘুরে গরু দেখেছি। তবে আমার জীবনে সেন্টু মিয়ার হালিমা ডেইরি ফার্মের গরুটির মতো এতো বড় গরু আর কোথাও দেখিনি।
বালুথুবা পূর্ব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ জানান, এ ইউনিয়নে ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক খামার গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে সেন্টু মিয়ার উদ্যোগে হালিমা ডেইরি ফার্ম নামে বিশাল একটি খামার গড়ে উঠেছে। তার ফার্মে অনেক বড় বড় গরু আছে। এ ফার্মের গরুগুলো প্রতি কোরবানি ঈদে বিক্রি করা হয়। ব্যক্তি উদ্যোগে যারা গরুর খামার দিয়েছে। তাদেরকে সরকার যদি ভালো পৃষ্টপোষকতা দেয়, তাহলে দেশে মাংসের চাহিদা পূরণ হবে। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বিষয়টি যেন তদারকি করে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আমিন খান বলেন, সেন্টু মিয়ার হালিমা ডেইরি ফার্মের কালা মানিকের ওজন প্রায় ১৮শ কেজি হবে। বিগত ৪ বছর ধরে তিনি গরুটি লালন-পালন করে আসছেন। সঠিক দাম না পাওয়ায় তিনি গত বছর কোনবানি ঈদে বিক্রি করতে পারেননি। যারা গরুটি কিনতে ইচ্ছুক তারা দাম করে নিতে পারেন। তিনি গরুটির দাম চেয়েছেন ২৫ লাখ টাকা। যদিও তিনি ২৫ লাখ টাকা বিক্রি করলেও তার লোকসান হবে। কারণ গরুর খাবারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খামারিদের অনেক লোকসান গুনতে হবে। গরুটির মান অনেক ভালো। আমার জানা মতে ফরিদগঞ্জ উপজেলায় এ রকম বড় গরু আর নেই।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলায় কোরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে ৭০ হাজার পশুর চাহিদা রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বেশি পশু আছে। এ জেলায় পশু কেনাবেচার জন্য অস্থায়ী ও স্থায়ী মিলে ২১২টি হাট বসানো হচ্ছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ডা. দেলোয়ার হোসেন জানান, ফরমালিন জাতীয় জিনিস এবং কেমিক্যাল জাতীয় জিনিস ছাড়াই পশুগুলোকে মোটাতাজাকরণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যার কারণে আধুনিক পদ্ধতিতে পশুগুলোকে মোটাতাজা করা হচ্ছে। যুরবাজ ও কালা মানিক গরু দুটির মালিকরা দাবি করছেন- তাদের গরুগুলো জেলার সবচেয়ে বড় গরু। তবে তার চেয়ে বড় গরুও থাকতে পারে। আমাদের কথা হচ্ছে যারা গরু পালন করছেন তাদের যেন লাভ হয়। সেদিকে আমরা খেয়াল রাখছি। জেলায় ছোটবড় প্রায় ৮ হাজার পশুর খামার রয়েছে। তার মধ্যে ৪ হাজারের অধিক গরুর খামার রয়েছে। এসব খামারিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হয়।
আনোয়ারুল হক/আরএআর