জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বহু স্মৃতিবিজড়িত নাম ‘স্কাইভিউ’। এই নিবাসে সাঁটানো রয়েছে একটি কবিতা। ২০১৮ সালের পহেলা অক্টোবর এই কবিতার জন্ম। যার রচয়িতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দেয়ালের বুকে লেখা কবিতার শিরোনাম ‘এসো পান্থ আমার নিবাসে’।

এই কবিতায় কবি এরশাদ লিখেছেন-

‘কে তুমি পান্থ থমকে দাঁড়ালে
আমার সম্মুখে-বিমুগ্ধ বিস্ময়ে।
চিনতে কি পারো-মনে কি পড়ে?
আমি যে তোমাদেরই একজন
ভালোবাসায় সিক্ত প্রাণের মানুষ।
এই নিবাসে স্মৃতির সম্ভার সাজিয়ে
বসে আছি তোমারই প্রতিক্ষায়।
এখানে আসবে-এখানে বসবে,
মনের যত কথা হবে বিনিময়
তোমার সনে নিভৃতে নির্জনে।’

শত ব্যস্ততার মাঝে একটু সময় পেলেই এরশাদ এই স্কাইভিউতে আসতেন। তার রাজনৈতিক জীবনে রংপুর সবচেয়ে বড় আঁতুরঘর। তাই রংপুর সফরে এলে শৈশবের স্মৃতি মোড়ানো সেনপাড়ার স্কাইভিউতে খানিকটা সময় কাটাতেন। সেখানে বসে পরিবারের লোকজনসহ দলের নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর নিতেন।

আজ এরশাদকে হারানোর চার বছর। এরশাদ নেই কিন্তু আছে স্কাইভিউ। সেখানে দেয়ালে মোজাইক পাথরে লেখা সেই কবিতাটি রয়েছে। কবিতার ভাষায় কবি এরশাদ যেন ডাকছেন তার ভক্ত অনুরাগীদের। বলছেন ‘এসো পান্থ আমার নিবাসে’। এই কবিতার আড়ালে আছে কত শত স্মৃতি।

দীর্ঘ ৩৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এইচ এম এরশাদ লিখেছেন অসংখ্য গান ও কবিতা। প্রকাশনায় এনেছেন জীবনকর্ম নিয়ে তার লেখা বেশ কয়েকটি বইও। শুধু লেখালেখি নয় নিয়মিত মাঠে গলফও খেলেছেন। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়লেও এরশাদের কথাবার্তা আর চলাফেরায় ছিল আবেগ, ভালোবাসা আর হৃদয়িক টানাপড়েন।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নামটি বহু গুণে গুণান্বিত। সেনা প্রধান থেকে সামরিক শাসক। রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। অতঃপর বিরোধীদলীয় নেতা। দীর্ঘ সামরিক ও রাজনৈতিক জীবনে বহুল আলোচিত-সমালোচিত অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাম নানা কারণে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত ভারতের কোচবিহার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পরে তার পরিবার রংপুরে চলে আসে। রংপুরেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এরশাদ। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭১-৭২ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তন করেন।

১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ওই বছরই আগস্টে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে এরশাদকে সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৯১ সালে এরশাদ গ্রেপ্তার হন। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় এরশাদ পাঁচটি করে আসনে বিজয়ী হয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি জামিনে মুক্ত হন।

২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দল জাতীয় পার্টি ১৪টি আসনে জয়ী হয়। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোট গঠন করেন তিনি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তার দল ২৭টি আসনে জয়ী হয়। এরপর দশম ও চলতি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

একাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালনের মধ্যেই ২০১৯ সালে অসুস্থ হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সিএমএইচে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন এবং সেখানেই ওই বছরের ১৪ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমজেইউ