ত্রাণের জন্যে ফির কি রাস্তাত নামা লাগবে
লকডাউনে অসহনীয় পরিস্থিতির কথা ভেবে দুশ্চিন্তায় দিনমজুররা
ক্রমাগত করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সরকারি সিদ্ধান্তে সোমবার (০৫ এপ্রিল) থেকে শুরু হচ্ছে সাতদিনের লকডাউন। সারাদেশের মতো রংপুরেও জরুরি সেবা ছাড়া বন্ধ থাকবে সবকিছু। হঠাৎ লকডাউনের ঘোষণায় আকাশ ভেঙে পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষের মাথায়। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
অনেকেই গত বছরের লকডাউনে অসহনীয় পরিস্থিতির কথা ভেবে আরও বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। তাদের একজন সোলেমান মিয়া। বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি।
বিজ্ঞাপন
রোববার (০৪ এপ্রিল) দুপুরে রংপুর স্টেশন এলাকায় কথা হয় দিনমজুর সোলেমান মিয়ার সঙ্গে। প্রতিদিন সকাল বেলা কোদাল আর ডালি সঙ্গে নিয়ে কাজের খোঁজে বেড় হন তিনি। তার মতো অনেকেই শ্রম বিক্রি করতে জড়ো হন স্টেশন এলাকায়।
সকাল থেকে বিকেল, কখনো সন্ধ্যা পর্যন্ত মজুরি দিয়ে যা পান তা দিয়ে চলে সংসার। এভাবে প্রতিদিন লড়তে হয় তাকে। কিন্তু লকডাউনের ঘোষণায় তিনি এখন চিন্তিত।
বিজ্ঞাপন
একদিন কাজ না করলে যাদের মুখে খাবার জোটে না, লকডাউন হলে তাদের পরিবার কীভাবে চালবে? এ প্রশ্নের উত্তর চাইছেন নিম্নআয়ের এসব দিনমজুর।
মাটিকাটা শ্রমিক সোলেমান মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার ঘরোত সোন্দেবার কইলে তো হবার নায়, হামার খাবারের ব্যবস্থা কোত থাকি হইবে? এই করোনা তো নতুন নোয়ায়। ইয়ার আগের বছরের কতা এ্যলাও ভুলি নাই। খাবার জন্যেত কত কষ্ট হইছে। ডিসি, এসপি, মেয়র, কাউন্সিলর সবার হাত-পাও ধরি একনা চাউল-ডাল পাচনু। এবার লকডাউনোত কি হইবে? নাকি ফির আগের মতো ত্রাণের জন্যে ফির কি রাস্তাত নামা লাগবে। হামার মতো গরীবের পেটতো লকডাউন বুজে না।
মুখে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে কঠোর হওয়ার কথা বলা হলেও ঘরে বাইরে কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। ধনী-গরিব, সচেতন, অসচেতন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কম বেশি সবার মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার উদাসীনতা।
সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রংপুর রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল, কাঁচাবাজার, জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গাদাগাদি করে মানুষের বেপরোয়া চলাচল উৎসবে পরিণত হয়েছে। এতে করে করোনা ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
দুপুরে রংপুর নগরের শাপলা চত্বর টার্মিনাল রোডে একসঙ্গে প্রায় ১৫-২০ জন শ্রমিককে একটি গাড়িতে করে যেতে দেখা যায়। তাদের একজন নির্মাণশ্রমিক সবুজ হোসেন। বয়সে তরুণ এই যুবক মুখে মাস্ক পরলেও সঙ্গীদের বেশির ভাগ ছিলেন মাস্কবিহীন।
স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে এভাবে চলাফেরার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সবুজ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার তো সবার মুকোত এ্যলাও মাস্ক পিন্দিবার পারে নাই। আগোত সোগকিছু করা উচিত ছিল। তারপরও না হয় লকডাউন। কিন্তু হুট করি লকডাউন দিবার দরকার ছিল না। এই লকডাউনোত তো টাকাওয়ালা মানুষের কোনো কষ্ট হবার নায়। যত কষ্ট সোগে হামার। কাম না করলে হামরা খামো কি? এমনি গত বছরের ঋণ এ্যলাও শোধ করিবার পাওনাই।
সোলেমান, সবুজের মতো সাধারণ দিনমজুর, কর্মজীবী, শ্রমজীবী, অসহায় ও নিম্নআয়ের মানুষের কাছে করোনার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর ক্ষুধার জ্বালা। এখন তাদের চোখে মুখে কপালে চিন্তার ভাঁজ। একদিন কাজ না করলে যাদের মুখে খাবার জোটে না, লকডাউন হলে তাদের পরিবার কীভাবে চালবে? পরিবারের খাবার কোথা থেকে আসবে? এসব চিন্তায় মলিন যেন সবাই।
গত বছরের ৯ মে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি ও বিস্তার প্রতিরোধে অনির্দিষ্টকালের জন্য রংপুর জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করেছিল জেলা প্রশাসন। করোনার সংক্রমণ ঝুঁকি রোধে লকডাউন চলাকালে অসহায় মানুষের কাছে সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগ ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগেনের পক্ষ থেকে পৌঁছে দেওয়া হয় ত্রাণ সহায়তা।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ফের নড়েচড়ে বসেছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। অন্যদিকে ত্রাণ সহায়তা প্রদানের ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনার অপেক্ষায় জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোশনসহ স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা।
এদিকে রংপুরে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গত বছরের ৪ এপ্রিল জেলায় প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছিল। এখন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় এক বছরে তা ৪ হাজার ২০৯ জনে দাঁড়িয়েছে। এ জেলায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৭৩ জন।
রংপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. হিরম্ব কুমার রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত এক সপ্তাহে (২৮ মার্চ হতে ৪ এপ্রিল) রংপুর জেলায় ৫৪ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছে। একই সময়ে নতুন করে করোনা আক্রান্ত কারও মৃত্যু হয়নি। তবে সারাদেশে এখন পর্যন্ত ৩১ জেলায় করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে রংপুরের অবস্থান ২৭ নম্বরে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএম