নিহত বিথীর স্বজনদের আহাজারি

নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনায় মুন্সিগঞ্জের ১৭ জন মারা গেছেন। এ ঘটনায় নিহতদের বাড়ি বাড়ি চলছে শোকের মাতম। ১০ মাসের ব্যবধানে দুই লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার।  

রোববারের দুর্ঘটনায় মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার রমজানবেগ এলাকার একই পরিবারের তিনজন মারা গেছেন। তারা হলেন- বীথি বেগম (২৫), তার মেয়ে আরিফা ( ১) এবং বীথির মা পাকিজা বেগম (৪০)।

সোমবার বীথিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মাটিতে শুয়ে বিলাপ করছেন নিহত বীথির ননদ রুপা ও জা জিয়াসমিন বেগম।

রুপা বলেন, শিশু আরিফার শরীরে এলার্জি দেখা দেওয়ায় তাকে রোববার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন বীথি ও তার মা পাকিজা বেগম। সন্ধ্যায় তারা নারায়ণগঞ্জের সাবিত আল হাসান লঞ্চে করে বাড়ি ফিরছিলেন। লঞ্চ ডুবে সবাই মারা গেল।

তিনি বিলাপ করে বলেন, আমার ভাবি লঞ্চ ডুবে যাওয়ার পর হয়ত ভেবেছিলেন আর বাঁচবেন না। তাই বুকের মনিকে বুকেই ধরে রেখেছিলেন। যারা তাদের লাশ উদ্ধার করেছেন তারাও এ দৃশ্য দেখে কেঁদেছেন।

নিহত বীথি আক্তার রমজানবেগ গ্রামের আরিফ কাজির স্ত্রী। আরিফ তার একমাত্র মেয়ে আরিফা (১) ও স্ত্রী বিথী বেগমকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ।

একই ঘটনায় স্ত্রী সুনীতা সাহা, দুই সন্তান আকাশ সাহা (১২) ও বিকাশ সাহাকে (২২) হারিয়েছেন শহরের মালপাড়া এলাকার সাধন সাহা। তিনি বলেন, ‘স্ত্রী সুনিতা সাহা রোববার সকালে দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকার জাতীয় চক্ষু ইন্সটিটিউট হাসপাতালে গিয়েছিল আকাশের চোখের চিকিৎসা করাতে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে শেষবার ফোনে জানিয়েছিল সাবিত আল হাসান লঞ্চে করে নারায়ণগঞ্জ লঞ্চঘাট হয়ে মুন্সিগঞ্জ ফিরছে তিনজন। সাড়ে ৬টার দিকে টিভিতে দেখলাম লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটেছে। এরপর থেকে স্ত্রী-সন্তানের মুঠোফোন বন্ধ। রোববার রাতে স্ত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সোমবার দুপুরে শেষ বিদায় করে এসেছি। সোমবার বড় ছেলের মরদেহ বাড়িতে এনেছি। ছোট ছেলেটা এখনো নিখোঁজ রয়েছে।’

নিহত সুনিতা সাহার বড় বোন মনি সাহা সোমবার শশ্মানের মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে বিলাপ করছিলেন। বিলাপ করতে করতেই বলছিলেন, ‘আমার বোনটা লঞ্চে উঠতে চাইত না। সব সময় বলত লঞ্চ ডুবে যাবে। খুব ভয় পেত। আমার বোনের ভয়টেই সঠিক হয় গেল, জীবিত আর ফিরতে পারল না সে।’ 

শোকের মাতম চলছিল উপজেলার চরডুমুরিয়া এলাকার সোলায়মান ব্যাপারি (৬০) ও বেবি বেগমের (৫০) বাড়িতেও। তারা স্বামী-স্ত্রী লঞ্চডুবিতে মারা গেছেন। তাদের স্বজনরা জানান, সোলায়মান ব্যাপারির ফুসফুস ক্যান্সার ছিল। চার দিন আগে তাকে কেমোথেরাপি দিতে ঢাকায় নেওয়া হয়। থেরাপি শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। মেয়ে তাদের বন্দর থেকে লঞ্চে উঠিয়ে শেষ বিদায় দেন।

রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে ‘সাবিত আল হাসান’ নামে যাত্রীবাহী লঞ্চটি নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জ যাওয়ার পথে নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর কাছাকাছি এলাকায় এসকে-৩ নামের একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় ডুবে যায়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। যার মধ্যে ১৭ জনের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ।

মুন্সিগঞ্জ নাগরিক সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সুজন হায়দার জনি বলেন, রাজধানী ঢাকার কাছের জেলা মুন্সিগঞ্জ। এই জেলার জনগণের ভাগ্য স্বাধীনতার ৫০ বছরেও পরিবর্তন হয়নি। নৌপথে নারায়ণগঞ্জ হয়ে অথবা মীরকাদিম লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চে করে সরাসরি ঢাকা যেতে পছন্দ করেন তারা। কিন্তু  এই দুই নৌপথও এখন সিন্ডিকেটের দখলে। প্রভাবশালী লঞ্চ মালিকরা সিন্ডিকেট করে দীর্ঘদিনের পুরোনো ফিটনেসবিহীন লঞ্চগুলো দিয়েই এই পথে যাত্রী পারাপার করছে। 

এদিকে ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার দুই পাশে নদী দখল করে গড়ে উঠেছে সিমেন্ট ফ্যাক্টরিসহ অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান। নদী দখল করে শত শত পণ্যবাহী জাহাজ নোঙর করে রাখা হয়েছে মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌপথে। এ কারণে নদীপথ সরু হয়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। 

মুন্সিগঞ্জ লঞ্চ ঘাটের ইজারাদার দীল মোহাম্মদ কোম্পানি বলেন, মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌপথে ২৫টি লঞ্চ চলাচল করে। এর মধ্যে ২৩টি লঞ্চ ৪৫ থেকে ৫৫ ফুট দৈর্ঘ্যের। মাত্র দুটি লঞ্চ ৬০ ফুটের ওপরে। এই লঞ্চগুলো দিয়েই প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। লঞ্চের আকার ছোট হওয়ায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।

দীল মোহাম্মদ বলেন, লঞ্চগুলোর আকার বড় করার জন্য বিআইডব্লিউটিএকে বার বার বলা হচ্ছে। তারপরও তারা বড় লঞ্চের অনুমোদন দিচ্ছে না। সেই সঙ্গে মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌপথের ধলেশ্বরী-শীতলক্ষ্যার মোহনায় সিমেন্ট ফ্যাক্টরিগুলো তাদের জাহাজগুলো যত্রতত্র অবস্থায় রেখেছে। যার ফলে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চগুলো চলাচল করছে। যেকোনো সময় আবারও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

এর আগে, গত বছরের ২৯ জুন সকালে এম এল মর্নিং বার্ড নামে যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে মুন্সিগঞ্জের ৩৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। দুর্ঘটনার পর গত বছর ৩০ জুন সদরঘাট নৌ-পুলিশের এসআই শামসুল আলম বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।  

এ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক মোসাদ্দেক হানিফ সোয়াদসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। এ মামলার এজাহারে দায়িত্বে অবহেলা ও বেপরোয়াভাবে মর্নিং বার্ড লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দিয়ে প্রাণহানির জন্য ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ২৮০, ৩০৪ (ক), ৩৩৭ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।

মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, এক বছরের মধ্যে বড় দুটি নৌ-দুর্ঘটনা মুন্সিগঞ্জের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া ফেলেছে। সামনের দিনগুলোতে যেন এমন ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, লঞ্চগুলোর আকৃতি বড় করতে বিআইডব্লিউটিএকে বলা হয়েছে। এ ছাড়া যারা নদীর মধ্যে যত্রতত্র জাহাজ রেখে নৌযান চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসপি/জেএস