লিবিয়ায় ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েল ও বন্যার তাণ্ডবে গত ১০ সেপ্টেম্বর রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার শাহিন প্রামাণিক (৩৫) ও সুজন খান (২৫) নামে দুই যুবকের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মৃত্যুর সংবাদ জানার পর থেকেই পরিবারে চলছে শোকের মাতম। বাড়িতে চলছে আহাজারি। শোকে ভারী হয়ে উঠেছে এলাকার পরিবেশ।

গত বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক বিবৃতিতে সুজন ও শাহিনের মৃত্যুর সংবাদটি নিশ্চিত হওয়া যায়।

নিহত সুজন খান রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার যশাই ইউনিয়নের ধোপাকেল্লা গ্রামের মৃত দুলাল খানের ছেলে। আর শাহিন প্রামাণিক একই উপজেলার হাবাসপুর ইউনিয়নের হাবাসপুর গ্রামের আরশেদ প্রামাণিকের ছেলে। 

জানা গেছে, লিবিয়ার ত্রিপোলি শহর থেকে এক হাজার ৩৪০ কিলোমিটার দূরের শহর দারনায় গত রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) রাতে ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েল আঘাত হানে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েলের প্রভাবে দারনা শহরে বসবাসরত ছয়জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্য থেকে চারজনের প্রাথমিক পরিচয় পাওয়া গেছে। 

তারা হলেন- রাজবাড়ীর শাহিন প্রামাণিক ও সুজন খান এবং নারায়ণগঞ্জের মামুন ও শিহাব। তবে দূতাবাসের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বাকি দুইজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি।

সরেজমিনে সুজন ও শাহিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনদের কান্না ও আহাজারিতে তাদের বাড়িতে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। এলাকার মানুষজন তাদের বাড়িতে ভিড় করেছে। ছেলে হারানোর কষ্টে সুজন ও শাহিনের মা বাকরুদ্ধ। ভাই হারানোর যন্ত্রণায় বোন কাঁদছে। তাদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। 

নিহত প্রবাসী শাহিনের দুলাভাই শাকির আহমেদ বলেন, শাহিন প্রায় ১২ বছর লিবিয়ায় ছিল। লিবিয়ায় থাকা অবস্থায় সে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিয়ে করে। ২০২০ সালে সে দেশে আসে। দেশে আসার পর তার এক ছেলে সন্তান হয়। ওই ছেলের বর্তমান বয়স দুই বছর। ১০ মাস আগে সে স্ত্রীকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় রেখে আবারও লিবিয়ায় চলে যায়। লিবিয়ায় যাওয়ার পর তার আরও একটি ছেলে সন্তান হয়। এই সন্তানের বর্তমান বয়স ছয় মাস। সর্বশেষ রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে শাহিনের কথা হয়। শাহিনের বড় ভাই জামাল প্রামাণিকও লিবিয়ায় থাকে। গত মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) সকালে জামাল বাড়িতে ফোন করে জানায় শাহিন ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে মারা গেছে। তাকে লিবিয়াতেই দাফন করা হয়েছে।

নিহত অপর প্রবাসী সুজনের বড় ভাই জুবায়ের খান বলেন, আমরা চার ভাইবোন। সুজন আমার ছোট। ২০০৯ সালে সুজনকে ছোট রেখে আমার বাবা মারা যান। এরপর থেকে আমি বাবার রেখে যাওয়া জমিতে কৃষিকাজ করে সুজনকে এসএসসি পাস করাই। পরে ধারদেনা করে চার লাখ টাকা খরচ করে ২০১৯ সালে সুজনকে লিবিয়া পাঠাই। 

লিবিয়া যাওয়ার পর সেখানে সুজন একটি ব্যাংকে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করতো। তিন বছর ভালোভাবেই কাজকর্ম করে বাড়িতে টাকা পাঠাতো। হঠাৎ লিবিয়া থেকে সে ইতালি যেতে গিয়ে দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে। দালালরা তাকে আটকে রেখে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন চালাতো। আমরা বাড়ি থেকে জমিজমা বিক্রি করে কয়েক ধাপে ২৩ লাখ টাকা দালালদের দিয়ে তাকে মুক্ত করি। এরপর সে আবারও ব্যাংকের কাজে যোগ দেয়। পাশাপাশি সে রংমিস্ত্রির কাজও করতো।  সর্বশেষ গত রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টার দিকে তার সঙ্গে আমাদের কথা হয়। মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে লিবিয়া প্রবাসী আমার মামাতো ভাই হাসান ফোন করে জানায়, ঘূর্ণিঝড়ে বিল্ডিংয়ের ছাদ ধসে তাতে চাপা পড়ে সুজন মারা গেছে। তার মরদেহ নাকি সেখানেই দাফন করা হয়েছে। আমার ভাইটা মারা যাওয়াতে আমাদের পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে গেল।

হাবাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আল মামুন খান জানান, আমার ইউনিয়নের শাহিন নামের এক যুবক লিবিয়ায় মারা গেছে। আমি তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিয়েছি। পরিবারের সবাই শোকাহত।

যশাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু হোসেন খান বলেন, আমার ইউনিয়নে সুজন খান নামে এক যুবক লিবিয়ায় মারা গেছেন। আমি তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। তার অকাল মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

পাংশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাফর সাদিক চৌধুরী জানান, হাবাসপুর ও যশাই ইউনিয়নের শাহিন ও সুজন নামে দুই যুবক লিবিয়ায় ঘূর্ণিঝড়ে মারা গেছেন। আমরা তাদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি।

রাজবাড়ীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সূবর্ণা রাণী সাহা বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে লিবিয়াতে রাজবাড়ীর দুই ব্যক্তি নিহতের জানতে পারলেও সরকারি কোনো তথ্য বা চিঠি আমরা পাইনি। তবে এ নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রাণালয় কাজ শুরু করে দিয়েছে। জেলা প্রশাসনের কাছে কোনো তথ্য বা সহযোগিতা চাইলে আমরা সেটি করবো।

মীর সামসুজ্জামান/আরএআর