সার্ভার ডাউন ভূতে ভুগছে জন্মনিবন্ধন সনদ
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন শাখা। সেখানে ছুটি ছাড়া প্রতিদিনই থাকে বিভিন্ন বয়সী মানুষের আনাগোনা। নিবন্ধন সনদ হাতে পাওয়ার আগে সার্ভার সমস্যা, বকশিশ আর ম্যানেজ মিশনের গ্যাঁড়াকলে পোহাতে হয় ভোগান্তি। যা নিয়ে সেবাপ্রত্যাশীদের অভিযোগের শেষ নেই।
গত মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) সকালে কিছু কাগজ নিয়ে নতুন ভবনের সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নামছিলেন এক ব্যক্তি। তিনি এসেছিলেন জন্ম নিবন্ধন সনদ নিতে। কিন্তু হতাশার ছাপ মুখে চেপে ফিরে যাচ্ছিলেন।
বিজ্ঞাপন
ভুক্তভোগী হাসান ফেরদৌস রাসেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, সবকিছু লিখে দেওয়ার পরও সনদে নাম ভুল আসে। তারপর ডিসি অফিসে আবার আবেদন করতে হয়। কিন্তু কেউ সঠিক তথ্যটা জানাতে চায় না। এ কারণে তৃতীয়পক্ষ বা দালাল ধরা ছাড়া উপায় থাকে না। জন্মনিবন্ধনের সনদ সংশোধন যেন সোনার হরিণ। ফরম পূরণ করে দেওয়ার পরও আমার মেয়ের জায়গায় লিঙ্গ পরিচয় ছেলে আসছে সঙ্গে নামের বানানও ভুল।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, চাকরিতে যোগদান, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ নাগরিক সেবার ১৯টি ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রয়োজন হয়। জন্ম নিবন্ধন একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যা সবার আবশ্যিক প্রয়োজন। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রয়োজনীয় দলিল হাতে পেতে দিনের পর দিন সিটি কর্পোরেশনের কার্যালয়ে ঘুরে ঘুরেও কোনো ফল পাচ্ছেন না নাগরিকরা।
বিজ্ঞাপন
গত ৭-৮ মাস ধরে রংপুর সিটি কর্পোরেশনে ঘুরেও মেয়ের এবং নিজের জন্মনিবন্ধন সনদ হাতে পাননি নগরের পূর্বশালবন শান্তিনগর এলাকার মাসুদ রানা সাকিল।
কারণ হিসেবে তিনি ঢাকা পোস্টেকে বলেন, প্রথমে ওরা (জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন শাখা) বলেছিল সনদ পেতে তিন মাস সময় লাগবে। তিন মাস পর খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম সনদ আসেনি। ডিসি অফিসে খোঁজ নিতে বলায় আমি সেখানে যাই। কিন্তু ডিসি অফিস থেকে আবার আমাকে সিটি কর্পোরেশনে খোঁজ নিতে বলা হয়।
তিনি আরও বলেন, কয়েকদিন পর জন্মনিবন্ধন শাখা থেকে জানতে পারলাম আমার আবেদনের কাগজপত্র হারিয়েছে। এতদিন নাকি এসব কাগজ থাকে না। ফেলে দেওয়া হয়। এ কারণে আমার কাছে পুনরায় টাকা চাওয়া হয়। আমার কাছে নিবন্ধন ফি জমা দেওয়ার রশিদ থাকা সত্ত্বেও জন্মনিবন্ধন সনদ পেলাম না।
আক্ষেপ করে মাসুদ রানা বলেন, আবার নতুন করে আবেদনের টাকা জমা দিলে আমার এবং মেয়ের জন্মনিবন্ধন সনদ যে পাবো তার নিশ্চয়তা কী? আবেদন করলে আবার তো ভূত আবেদনের কপি নিয়ে যাবে। এখানে অদক্ষ জনবলের পাশাপাশি কিছু দালাল প্রকৃতির লোকজন রয়েছে। যাদের কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা নিতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
এই অভিযোগ শুধু হাসান ফেরদৌস আর মাসুদ রানার নয়। জন্মনিবন্ধন সনদ করতে গিয়ে এমন বিড়ম্বনায় পড়েছে সিটির পাশাপাশি উপজেলা ও ইউনিয়নে বাস করা রংপুরের হাজারো মানুষ। স্কুল-কলেজে ভর্তি, পাসপোর্ট, বিয়ে কিংবা করোনার টিকাসহ এখন সবখানে অতিজরুরি জন্মনিবন্ধন সনদ। জন্মনিবন্ধন ছাড়া যেন সব কিছুই অচল। আর এই অচল অবস্থা সচল করতে বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যেন সার্ভার ডাউন ভূত চেপেছে বসেছে। তার ওপর ভুলে ভরা নিবন্ধন ঠিক করতেও নাজেহাল হতে হচ্ছে।
নগরীর ২২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আদুরী বেগমের সঙ্গে কথা হয় সিটি কর্পোরেশনের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন শাখায়। ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদককে তিনি বলেন, আমার মেয়ের নামের ভুল সংশোধনের জন্য আবেদন করেছিলাম। প্রায় তিন মাস পর সনদ পেলাম। এর মাঝে বেশ কয়েকবার এসে ঘুরে গিয়েছি।
রংপুর সিটি কর্পোরেশনে ৩৩টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে সাধারণ কাউন্সিলরের (পুরুষ) পাশাপাশি তিনটি ওয়ার্ড মিলে একজন করে সংরক্ষিত (নারী) কাউন্সিলর রয়েছে। তাদের কাছে গড়ে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচজন জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে পরামর্শ নিতে আসেন। এতে জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে না পারায় কাউন্সিলররাও বিপাকে পড়েছেন বলে দাবি করেন ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহমুদুর রহমান টিটু।
ঢাকা পোস্টকে এই কাউন্সিলর বলেন, সার্ভার ডাউনের কারণে খুব সমস্যায় আছি। মানুষ তো সার্ভার সমস্যা বুঝবে না। তারা আমাদের কথা না বুঝেই নানান রকম অভিযোগ করে। কেউ কেউ দালাল ধরে হয়রানীও হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবেই সার্ভার ডাউন। এটাতো আমাদের হাতে নেই, সরকারি ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। প্রতিদিন অন্তত ২০০ বেশি সনদ প্রদান করা জরুরি। অথচ সেখানে বেশিরভাগ সময় থাকছে না সার্ভার। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের মতো আমরাও জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়ে সীমাহীন ভোগান্তিতে রয়েছি।
দালালদের বকশিশ দিলে দ্রুত জন্মনিবন্ধন সনদ পাওয়া সম্ভব কিনা জানতে চাইলে কাউন্সিলর মাহমুদুর রহমান বলেন, সিটিতে কোনো দালাল নেই। যাদের দেখেছেন সবাই কর্মচারী। এখন কেউ যদি নিজের স্বার্থে কাউকে খুশি রাখতে বকশিশ দেয়, সেটা তো তার ব্যাপার। তবে আমরা কাউন্সিলররা চেষ্টা করছি যাদের খুব জরুরি প্রয়োজন তাদেরকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, মূলত জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের ফি সিটি কর্পোরেশন পাবে নাকি সরাসরি সরকারি কোষাগারে জমা হবে– এ নিয়ে তৈরি হয়েছে সমস্যা। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ফি পরিশোধে সম্প্রতি ই-পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। ফলে এই ফি সরাসরি চলে যাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। এ কারণেই প্রায়ই সার্ভার ডাউন ভোগান্তিতে ব্যাহত হচ্ছে নিবন্ধন সেবা।
সম্প্রতি তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের জেসমিন আক্তার স্কুলপড়ুয়া সন্তানের জন্ম নিবন্ধন তুলে দেখেন সেখানে ভুল তথ্য নিবন্ধন করা। সংশোধনীর জন্য ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার গেলে তার ও স্বামীর নিবন্ধন চাওয়া হয়। এরপর জেসমিন নিজের ও স্বামীর নিবন্ধন উঠান। এতে ভোগান্তি আরও বাড়ে। এবার জেসমিনের ও স্বামীর জন্ম নিবন্ধনে নাম ভুল আসে। সেটা ঠিক করতে এখন প্রয়োজন তাদের বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন।
পরিষদের মাঠে আক্ষেপ করে ঢাকা পোস্টকে জেসমিন আক্তার বলেন, ‘ছাওয়াটার নিবন্ধন ঠিক কইরার যায়া এ্যলা স্বামীর আর মোর নিবন্ধন ভুল। ভোটার আইডি কার্ডে মোর নাম জেসমিন আক্তার জন্মনিবন্ধনে তাক জসেমনি আক্তার, আর ওমার (স্বামী) নামতো গোটালে ভুল আসছে। এ্যলা ফির হামার দুইজনরে বাপ-মায়ের জন্ম নিবন্ধন চাহিচে।’
তিনি বলেন, ভোটার আইডি কাডোত সউগ ঠিক আছে। তাও নাকি জন্ম নিবন্ধন ছাড়া কাম হবার নায়। কয়দিন থাকি পরিষদোত ঘুরিছি, তাও জন্ম নিবন্ধন ঠিক হওচে না। এ্যলা মনটায় কওছে ছাওয়া (সন্তান) জন্মের কষ্টের চ্যায়া জন্ম নিবন্ধনের কাগজ হাতোত পাওয়া বেশি কষ্টের।
এ ধরণের রকম অভিযোগ জেলার সবখানেই। কেউ বলছেন বকশিশ দিলেই সবকিছু ঠিকঠাক পাওয়া যাচ্ছে। আবার কারো অভিযোগ নাম সংশোধনে বিড়ম্বনা বেশি। জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে ধরনা দিয়েও কাজ হচ্ছে না। তবে সার্ভার ডাউনের কারণেই ভোগান্তি বেড়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
এ বিষয়ে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন শাখার নিবন্ধক মোহাম্মদ আলী বলেন, প্রতিদিন ১০০টির বেশি আবেদন জমা পড়ছে। আমরা চেষ্টা করছি গুরুত্ব বুঝে দ্রুত সনদ প্রদানের জন্য। কিন্তু সার্ভার ডাউনের কারণে অনেক কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। সার্ভার না থাকা এটা আমাদের কোনো সমস্যা নয়, এটি নিয়ন্ত্রিত হয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে। আমরা কোনোকিছু বন্ধ করে রাখি না। সার্ভার পাওয়া যায় না মাঝে মাঝে, তখন আমরা সেবাগ্রহীতাদের ফেরত পাঠাই। সার্ভার ডাউন থাকার কারণে যদি কেউ সেবা না পায়, সেখানে আমাদের তো কিছু করার নেই।
তিনি আরও জানান, সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন এলাকায় কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করলে তার মা-বাবাকে প্রথমে ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসের মাধ্যমে ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়। জন্ম সনদ নিতে প্রথমে অনলাইনে আবেদন করে ব্যাংকে নির্ধারিত সরকারি ও অফিস ফি জমা করতে হয়। সিটি কর্পোরেশনের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন শাখায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তথ্য ইনপুট দেন। পরে সেটি ভেরিফাই হয়ে আসে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে। কিন্তু কোনো ভুল হলে সেটি সিটি কর্পোরেশন থেকে সংশোধন করা যায় না। সেক্ষেত্রে যেতে হয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে।
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, এখন যে অবস্থা তাতে ৩০ টার সনদ বেশি প্রিন্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা প্রতিদিন ১০০ করে সনদ প্রদানের জন্য জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়কে চিঠি দিয়ে বলেছি। কিন্তু সার্ভার ডাউনের কারণে সবাই মহাবিপদে আছে। তারপরও আমার নির্দেশ রয়েছে, শিক্ষার্থীসহ বিদেশ ভ্রমণে যাদের সনদ খুব বেশি প্রয়োজন, তাদেরকে যেন গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমরা ঢাকায় কথা বলেছি আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান হবে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএএ