নিহত শামিমা খাতুন

চলতি বছরের জুন মাসে শামিমা খাতুনের (২৭) সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় শাহাবুল ইসলামের। কয়েকদিন যেতে না যেতেই যৌতুকের দাবিতে শামিমার ওপর শারীরিক নির্যাতন শুরু হয়। দাবি অনুযায়ী যৌতুকের দুই লাখ টাকাও দেন শামিমার বাবা। মাস যেতেই আবারও পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে শামিমার স্বামী শাহাবুল। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আবারও শুরু হয় শামিমার ওপর শারীরিক নির্যাতন।

দিন দিন নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলছিল। বিষয়টি জানতে পেরে শামিমাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন তার বাবা মোতাহার হোসেন পান্নু। পরে স্বামীর অনুরোধে তাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হয়। গতকাল বুধবার (১৮ অক্টোবর) সকালে চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গা উপজেলার ঘোলদাড়ি গ্রামের কুটিপাইকপাড়ার শ্বশুরবাড়ি থেকে শামিমা খাতুনের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। 

পরিবারের অভিযোগ, স্বামী শাহাবুল নির্যাতনের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে মরদেহ ঝুলিয়ে রেখেছে। 

নিহত শামিমা খাতুন আলমডাঙ্গা উপজেলার ডাউকি গ্রামের মোতাহার হোসেন পান্নুর মেয়ে এবং একই উপজেলার ঘোলদাড়ি গ্রামের কুটিপাইকপাড়ার ভূসিমাল ব্যবসায়ী শাহাবুল ইসলামের স্ত্রী। 

মেয়েকে হারিয়ে বাবা মোতাহার হোসেন পান্নু ও মা চায়না খাতুন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিন বোনের মধ্যে শামিমা ছিল সবার ছোট। 

পরিবারিক সূত্রে জানা গেছে, শামিমা খাতুন মেধাবী ছিলেন। নিজের গ্রামের বিদ্যালয় থেকেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক গণ্ডি পেরিয়ে আলমডাঙ্গা মহিলা কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে অনার্স শেষ করেন। ঝিনাইদহের সরকারি কে সি কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। এরপর বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল শামিমা। তার আগেই লাশ হয়ে ফিরতে হলো। 

শামিমার চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ আল তারেক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিয়ের কয়েক দিন পরই যৌতুকের টাকার দাবি করে শাহাবুল। শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। মেয়ের সুখের কথা ভেবে শামিমার বাবা তার জামাইকে দুই লাখ টাকাও দেন। পরবর্তীতে আবারো ব্যবসার জন্য পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। অসহায় বাবার পক্ষে টাকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। এরপর থেকে নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে বাড়িতে এসে নির্যাতনের কথা জানায় শামিমা। স্বামীর অনুনয়-বিনয়ের কারণে বাবার বাড়ি থেকে গত ১৪ অক্টোবর আবার শ্বশুরবাড়িতে যান। সঙ্গে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে বইপত্রসহ সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে যান। শামিমার স্বপ্ন ছিল সরকারি কর্মকর্তা হবে। সেই যাওয়ায় যে তার শেষ যাওয়া হবে আমরা কেউ বুঝতেই পারেনি।

তিনি আরও বলেন, ঘটনার দিন সকালে খবর পেয়ে আমিসহ দুজন শামিমার শ্বশুরবাড়িতে যাই। বাড়ির আঙ্গিনায় তার মরদেহ রাখা ছিল। আমাদের জানানো হয়, গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তবে আমরা দেখেছি শামিমার শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। আমরা পুলিশকে জানালে তারা ঘটনাস্থালে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সদর হাসপাতালে পাঠায়। 

এ খবর শোনার পর থেকেই শামিমার বাবা-মা অসুস্থ হয়ে বিছানাগত হয়ে পড়েছেন। মেয়ে হারানোর শোকে তারা ঠিকমতো কথাও বলতে পারছেন না। সঠিক তদন্ত করে মেয়ে হত্যার বিচারের দাবি করেছেন তারা।

এদিকে গতকাল বুধবার দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে শামিমার মরদেহ পরিবারের নিকট হস্তান্তর করে পুলিশ। এ ঘটনায় আলমডাঙ্গা থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। বিকেলে শামিমার মরদেহ নিজ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালে শোকের ছায়া নেমে আসে। বাদ মাগরিব জানাজা শেষে গ্রামের কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে শামিমার স্বামী শাহাবুল ইসলামের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বয়োবৃদ্ধ বাবা মোতাহার হোসেন পান্নু তার নিজের সম্পত্তি তিন মেয়ের নামে ভাগবাটোয়ারা করে দিয়েছেন। সেই জমি বিক্রি করে টাকা আনার জন্য চাপ দিতে থাকেন শামিমার স্বামী শাহাবুল। শামিমা জমি বিক্রিতে সম্মত না হওয়ায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করে স্বামী। ধারণা করা হচ্ছে এসব কারণেই শামিমাকে হত্যার পর মরদেহ ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যার প্রচার করা হচ্ছে।

আলমডাঙ্গা থানা পুলিশের পরিদর্শক (ওসি) বিপ্লব কুমার নাথ ঢাকা পোস্টকে জানান, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে বিস্তারিত জানা যাবে এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা। 

আফজালুল হক/আরএআর