সিরাজুল ইসলাম (২৮)। কক্সবাজার কুতুবদিয়া উপকূলের বাসিন্দা। তার জীবনে ‘হামুন’-এর মতো ভয়াবহ তাণ্ডব আর কখনো দেখেননি। তার দাবি, ঘূর্ণিঝড়ে হঠাৎ করে কিছু বুঝে উঠার আগেই ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে পুরো উপকূলবাসী। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ারও সময় পাননি তারা। এমনকি দুর্যোগ পূর্বকালীন কোনো সতর্কবার্তাও পাননি।

বুধবার (২৫ অক্টোবর) প্রতিবেদকের কাছে এসব কথা বলেন কুতুবদিয়া পাড়ার বাসিন্দা সিরাজুল হকসহ ক্ষতিগ্রস্তরা।

মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) সন্ধ্যায় আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় হামুনে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে কক্সবাজার। এখনো রাস্তায় রাস্তায় পড়ে আছে বৈদ্যুতিক খুঁটি এবং গাছ। দেয়াল ধসে এবং গাছ পড়ে এ পর্যন্ত তিনজন নিহতের পাশাপাশি আহত হয়েছে শতাধিক।

জেলা প্রশাসনের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণীতে থেকে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কক্সবাজার জেলার ৭১টি ইউনিয়ন এবং কক্সবাজার ও মহেশখালী পৌরসভা। জেলায় দুর্গত মানুষের সংখ্যা ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫৪৯ জন। ৪২ হাজার ৯৫৯টি বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। যার মধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা ৫ হাজার ১০৫টি এবং আংশিক বিধ্বস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা ৩২ হাজার ৭৪৯টি। অন্যদিকে হামুনের তাণ্ডবে পল্লী বিদ্যুতের ৩৫৪টি বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে গেছে, ২৩টি ট্রান্সফরমার বিকল হয়েছে, ৪৯৬টি স্থানে তার ছিঁড়ে গেছে, ৮০০টি স্থানে গাছ পড়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে বলে বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়। কক্সবাজার পৌরসভা, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর উপজেলার অনেক এলাকা এখনো বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় আছে।

কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড কুতুবদিয়া পাড়ার বাসিন্দা ফাতেমা বেগম বলেন, অন্য সময় ঘূর্ণিঝড় নিয়ে সতর্ক ও প্রচারণা থাকলেও এবার কিন্তু সেটা করা হয়নি। ঘূর্ণিঝড় শুরু হওয়ার ঠিক ঘণ্টাখানেক আগে আমাদের জানানো হয়। এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা কোথায় যাব। এর দায়ভার কে নেবে?

এদিকে কক্সবাজার আবহাওয়া স্টেশনের রাডার সাত দিন আগে থেকে অচল ছিল বলে স্বীকার করেছেন আবহাওয়া অধিদপ্তর কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. ইমাম উদ্দিন।

তিনি জানান, গত দুই সপ্তাহ ধরে কক্সবাজার স্টেশনের রাডারটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অচল রয়েছে। যার মাধ্যমে কক্সবাজার স্টেশন থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরবর্তী সমুদ্র এলাকার আবহাওয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি যান্ত্রিক ক্রটির কারণে এটি অচল থাকায় আবহাওয়ার সার্বিক তথ্য যথাযথভাবে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের অন্য রাডার স্টেশনগুলো সচল থাকায় আবহাওয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কক্সবাজারের রাডারটি সচল থাকলে আরও প্রকৃত তথ্য সরবরাহ করা সম্ভব হতো।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ১৯৬৯ সালে সুইডিশ শিশুকল্যাণ সংস্থা ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সহযোগিতায় কক্সবাজার রাডার স্টেশনটি স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ২২ এপ্রিল জাপান সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় রাডার সিস্টেমের উন্নয়ন করা হয়। যে রাডার স্টেশনটি কক্সবাজার হিলটপ সার্কিট হাউসের পাশে অবস্থিত। সমতল ভূমি থেকে ৬০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় প্রায় ৯৯ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ভবনের উপর রাডারটি স্থাপন করা হয়।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় হামুন-এর কারণে যাদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবাইকে ঢেউটিনসহ খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।

কক্সবাজার-২ (কুতুবদিয়া-মহেশখালী) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক জানান, যতটুকু সম্ভব পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে ঊর্ধ্বতন মহলেও যোগাযোগ করা হচ্ছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাধ্যমে ত্রাণ কার্যক্রম চলছে। মহেশখালীতে একজন নিহত ও বেশ কয়েকজন সাপের কামড়ে আহত হয়েছে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে আছি আমরা। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে।

কক্সবাজার বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, বেশির ভাগ জায়গায় বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে গেছে এবং ট্রান্সফরমার বিকল হয়ে গেছে। তাই বিদ্যুৎ পুরোপুরি ঠিক হতে দুই দিন সময় লাগতে পারে।

সাইদুল ফরহাদ/এমজেইউ