র‌্যাব-ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে রাস্তা থেকে মানুষ তুলে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা একটি চক্রের চার সদস্যকে আটক করেছে র‌্যাব-১৪’র একটি দল।

একইসঙ্গে উদ্ধার করা হয়েছে অপহৃত তিন ভুক্তভোগীকে। বেশ কিছুদিন ধরেই চক্রটি বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছিল বলে জানিয়ে বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) র‌্যাব-১৪ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে চক্রটির অপতৎপরতা নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান। এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় অভিযান চালিয়ে ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে তাদেরকে আটক করা হয়।

মহিবুল ইসলাম খান জানান, চক্রটি তাদের তৎপরতা শুরু করে টাঙ্গাইল থেকে। জেলার ভূঞাপুর, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা ও ত্রিশাল এলাকায় তিনটি অপহরণের ঘটনা ঘটায়। শুরুতে বুধবার সকালে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর গোবিন্দাস বাজারের মাংস ব্যবসায়ী রফিকুল তালুকদারকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। চোরাই গরু কেনার অপরাধে তাকে ধরা হচ্ছে বলে স্থানীয়দের জানিয়ে জোর করে গাড়িতে তুলে চোখ-মুখ বেঁধে পেটানো শুরু করে। গাড়িতে তোলার আগে দোকান থেকে ৪০ হাজার টাকাও নিয়ে নেয় চক্রটি। পরে রফিকের স্ত্রীর কাছে র‌্যাবের মেজর পরিচয়ে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে এবং গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। 

সাদা মাইক্রোবাসে চলতি পথে মুক্তাগাছার নিমুরিয়া এলাকায় চলন্ত মোটরসাইকেল থামিয়ে মাদক ব্যবসায়ী আখ্যা দিয়ে তুলে নেয় আসাদুজ্জামানকে। তিনি বাংলালিংক সিম কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। নিজের অফিসের কাজে মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার পথে র‌্যাব প্রধান পরিচয়ে মাদক আছে বলে জোর করে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। চক্রের দুই সদস্য আসাদের মোটরসাইকেলটি নিয়ে যায়। পরে আসাদের স্ত্রীর কাছে ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়।
 
গাড়িতে তুলে অস্ত্রের মুখে অসহনীয় নির্যাতন চলাতে থাকে আসাদের ওপর। চক্রটি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশালের বাগান রাঙ্গামাটিয়া এলাকায় মুদি দোকানের কর্মচারী মো. হাফিজুল ইসলামকে তুলে নেয়। সে দোকানে কাজ করার পাশাপাশি ভ্যান চালায়। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাফিজুলকে নিজেদের গাড়ির কাছে ডেকে নেয় চক্রটির সদস্যরা। পরে র‌্যাব পরিচয়ে জোর করে গাড়িতে তুলে হাত-পা ও চোখ-মুখ বেঁধে পেটাতে থাকে। ওই সময় হাফিজুলের সঙ্গে থাকা ৪০ হাজার টাকা নিয়ে যায় চক্রটির সদস্যরা।
 
এদিকে বাংলালিংক কোম্পানির প্রতিনিধিকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়ার খবরে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ র‌্যাব-১৪ কার্যালয়কে জানায়। খবর পেয়ে র‌্যাবের একাধিক টিম চক্রটিকে ধরতে মাঠে নামে। বুধবার সন্ধ্যার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভালুকার স্কয়ার মাস্টার বাড়ি এলাকা থেকে চক্রটির প্রধানসহ চার সদস্যকে আটক করা হয়। 

তারা হলেন, র‌্যাব প্রধান পরিচয় দেওয়া মাহবুব আলম রাসেল (৪৩), মনির হোসেন (৪০), মো. মুছা শেখ (২৪) ও সবুজ বিশ্বাস (২৪)। এর মধ্যে রাসেলের বাড়ি সিরাজগঞ্জের আমিনপুর গ্রামে, মনিরের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে, মুছার বাড়ি সিরাজগঞ্জে এবং সবুজের বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপায়। তাদের কাছ থেকে ৫ রাউন্ড গুলিসহ একটি বিদেশি পিস্তল, র‌্যাবের দুইটি ভুয়া আইডি কার্ড, ডিজিএফআই এর ভুয়া আইডি কার্ড, ৫টি বাটন মোবাইল ফোন, একটি সাদা রংঙের হায়েস মাইক্রো, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ট্যাক্স টোকেন, রোড পারমিট সার্টিফিকেট, ফিটনেস সনদপত্র, একটি চাবি ও ছিনতাইকৃত ৬৬ হাজার টাকা। র‌্যাবের তৎপরতা দেখে চক্রটির আরও কয়েকজন সদস্য পালিয়ে গেছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চক্রটি জানায়, তারা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ভুয়া র‌্যাব ও ডিবি পরিচয় দিয়ে মানুষকে তুলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করতো। এতের মধ্যে র‌্যাব প্রধান পরিচয় দেওয়া রাসেলের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে আরও চারটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে তিনটিই প্রতারণার মামলা। র‌্যাবের হাতে আগেও একবার গ্রেপ্তার হয়েছিল দলটির প্রধান রাসেল। চক্রটিই গত ১০ জুলাই ভালুকার বীকন গ্রুপের একজন কর্মচারীকে তুলে নিয়ে ৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় র‌্যাব পরিচয়ে। গাড়ি তুলে টাকা নিয়ে পাশবিক নির্যাতন শেষে ছাড়া হয়েছিল সেই কর্মীকে। সেই ঘটনা স্বীকার করে দলটির প্রধান রাসেল।

র‌্যাব-১৪’র অধিনায়ক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে র‌্যাব ও ডিবি পরিচয়ে অপহরণের কাজ করছিল চক্রটি। চক্রের সঙ্গে অন্য যারা জড়িত আছে তাদের শনাক্তে কাজ চলছে। তিনি বলেন, আসল র‌্যাব কখনও পোশাক ছাড়া কিংবা পরিচয়পত্র ছাড়া কোনো অভিযানে যায় না। অভিযানে ১০ জনের নিচে সদস্য থাকে না। এ ধরনের তৎপরতা রোধে র‌্যাব মাঠে কাজ করছে। মানুষকে সচেতন হতে হবে। কাউকে সন্দেহ হলে দ্রুত জাতীয় জরুরি সেবা ও র‌্যাব কন্ট্রোল রুমে জানাতে হবে।

উবায়দুল হক/এমএএস