আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে গত সোমবার (৪ ডিসেম্বর) এক প্রজ্ঞাপনে সারা দেশের ৪৭ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) বদলি করা হয়। সেই তালিকায় রয়েছে নওগাঁর সাপাহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্ল্যাহ আল মামুনের নামও।

এ উপজেলায় দীর্ঘ ২ বছর ৮ মাস দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে গেছেন তিনি। তাই তার বদলির খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েন এ উপজেলার অনেক মানুষ।

বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) সাপাহার উপজেলায় শেষ কর্মদিবস ছিল ইউএনও আব্দুল্ল্যাহ আল মামুনের। সকালে অফিসে আসা মাত্রই উপজেলা পরিষদ চত্বরে তাকে দেখতে ভিড় জমান স্থানীয়রা। বিদায় বেলায় ইউএনও মামুনের সামনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। তাদের মধ্যে একজন প্রতিবন্ধী বিমল মর্মু ইউএনওকে জড়িয়ে ধরে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘স্যার আপনি এত তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছেন। আপনার সহযোগিতা পেয়ে এখন তিনবেলা ঠিকমতো খেতে পারছি। আপনি গেলে আমাদের মতো অসহায়দের কে দেখবে’।

শিরন্টি ইউনিয়নের বিন্নাকুড়ি গ্রামের প্রতিবন্ধী বিমল মর্মু জন্মের পর থেকেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন না। তাই কাজ করে চলার মতো সক্ষমতা ছিল না তার। বিমল মর্মুর পরিবারের অন্য সদস্যরাও প্রতিবন্ধী। ২ মাস আগে নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে ইউএনও আব্দুল্ল্যাহ আল মামুনের কাছে সহযোগিতা চাইতে এসেছিলেন তিনি। ওই মুহূর্তে প্রতিবন্ধী বিমল মর্মুকে তার এলাকায় ৪০ হাজার টাকা খরচ করে একটি দোকান করে দেন ইউএনও মামুন। ওই দোকানের আয়েই বর্তমানে বিমল মর্মুর সংসার চলছে।

বিমল মর্মুর মতোই ইউএনও মামুনের কাছে সাহায্যের জন্য ছুটে গিয়েছিলেন সাপাহার সদর ইউনিয়নের মজিদপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা শাহানাজ পারভীন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, চার মাস আগে সড়ক দুর্ঘটনায় আমার ৯ বছর বয়সী ছেলের গলার হাড় ভেঙে যায়। ছেলেকে চিকিৎসা করানোর মতো টাকা ছিল না। ইউএনও স্যারের সঙ্গে দেখা করার পর ৩৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। ছেলেকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার জন্য আরও টাকার প্রয়োজন। স্যার আশ্বস্ত করেছিলেন আরও সহযোগিতা করবেন। এর মধ্যেই তিনি বদলি হলেন। এখন আমার ছেলের কী হবে সেই দুশ্চিন্তায় আছি।

সাপাহার উপজেলার একাধিক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, অসহায়-দুস্থরা তাদের প্রয়োজনে ইউএনও আব্দুল্ল্যাহ আল মামুনের কাছে গিয়ে কখনো খালি হাতে ফেরেনি। সকলের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বলভাবে কথা বলতেন তিনি। সরকারি-বেসরকারি যেকোনো দপ্তরে কেউ হয়রানি হলে তা তাৎক্ষণিক সমাধান করতেন। অনেক অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছেন। তাই তার কাছে গিয়ে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পেত সবাই। সকলের সঙ্গে এত সুন্দরভাবে মিশে থেকেছেন তিনি। উপজেলার সকল ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন করার পাশাপাশি অনেকের কর্মসংস্থান করে দিয়েছেন। তার মতো সৃজনশীল, চৌকস ও জনবান্ধব ইউএনওকে হারানো মেনে নেওয়া আমাদের জন্য কষ্টদায়ক। চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে সব জায়গায় এখন মূল আলোচনা ইউএনও মামুন আর কিছুদিন এ উপজেলায় থাকলে সাপাহারের আরও অনেক উন্নতি হতো।

২০২১ সালের ১৩ এপ্রিল সাপাহারে ইউএনও হিসেবে যোগদান করেন আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন। এরপর করোনা মোকাবিলায় সম্মুখসারিতে থেকে কাজ করেছেন তিনি। করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিটি প্রান্তে ছুটে গিয়ে মানুষকে ঘরে থাকতে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অনুরোধ করেছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন খাদ্যসামগ্রী। এই কাজ করতে গিয়ে উপজেলার সর্বস্তরের মানুষের অনেক কাছাকাছি পৌঁছানোর সুযোগ পেয়েছিলেন আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন। ওই মুহূর্তে তিনি ও তার পরিবারে সদস্যরা পরপর দুইবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। করোনার প্রাদুর্ভাব কমে যাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে করোনাকালীন শিক্ষার ঘাটতি পূরণে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন। সুযোগ পেলেই তিনি ছুটে যেতেন উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। নানান গল্পের ছলে শ্রেণিকক্ষে গিয়ে নিজেই পাঠদান করাতেন প্রাথমিক পর্যায়ের কোমলমতি শিশুদের। অনুপ্রেরণা যোগাতেন মানুষ হয়ে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করার। যার স্বীকৃতিস্বরূপ দুইবার জেলা এবং একবার বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ইউএনও নির্বাচিত হন। সাপাহার উপজেলায় কাজ করতে গিয়ে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ক্রীড়া, পর্যটনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে সাপাহারকে আধুনিক ও মডেল উপজেলায় রূপান্তর করেছেন আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন। আন্তরিকতা ও সেবার মনোভাবের জন্য আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন বরাবরই সর্বমহলে বেশ প্রশংসিত। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি শুদ্ধাচার পুরস্কারও পেয়েছেন।

তার সৃজনশীল পরিকল্পনায় উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলো পুরো নওগাঁ জেলাতেই বেশ প্রশংসিত হয়েছে। তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে এবং ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের দৃশ্যকল্প ফুটিয়ে তুলতে উপজেলা পরিষদ চত্বরে তিনি ‘জয় বাংলা চত্বর’ নির্মাণ করেছেন। সারা দেশে আম্রপালি আমের জন্য প্রসিদ্ধ উপজেলা সাপাহারকে ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করতে নির্মাণ করেছেন ‘আম চত্বর’। তরুণ প্রজন্মের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ, মাদক থেকে দূরে রাখা এবং বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় টেনিস খেলার সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নির্মাণ করেছেন ‘সাপাহার টেনিস কোর্ট’। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিকাশে উপজেলা পরিষদ চত্বরে নির্মাণ করেছেন ‘মুক্তমঞ্চ’। যেখানে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ও স্থানীয় শিল্পীদের দ্বারা নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উপজেলার স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের হাঁটাহাঁটির জন্য উপজেলা পরিষদ পুকুরের চারপাশে ‘পদাঙ্ক’ নামক  হাঁটার পথ নির্মাণ করেছেন।

এছাড়া ‘নিকুঞ্জ’ নামে উপজেলা প্রশাসন বাগান, ‘ব্র্যান্ডিং সাপাহার’, উপজেলা পরিষদের মূল ফটক (বাস্তবায়নাধীন), ‘টেরাকোটা সম্বলিত ত্রিমাত্রিক মানচিত্র’ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন। সাপাহারের ঐতিহ্যবাহী জবই বিল কেন্দ্রিক পর্যটন আকর্ষণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘জবই বিল মাছ চত্বর’, ‘জবই বিল সেলফি পয়েন্ট’, ‘বিল বিলাস’  নামক বসার স্থাপনা, ‘ব্র্যান্ডিং জবই বিল’, তথ্যচিত্রে জবই বিল (বাস্তবায়নাধীন) ও বিল পাড়ে বসার বেঞ্চ নির্মাণ করেছেন। এতে জবই বিলকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারও মানুষের। ‘শোভিত কানন’ নামে জবই বিলে শোভাবর্ধক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন ইউএনও আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন। প্রচণ্ড খরায় প্রায় শুকিয়ে যাওয়া বিলে হুমকির মুখে পড়া মৎস্য সম্পদ রক্ষায় বিলের চারটি অংশে অভয়াশ্রম ঘোষণা, মাছ শিকার নিষিদ্ধ, পাহারাদার নিযুক্ত ও পানি সেচের ব্যবস্থা করে জবই বিলের মা মাছ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করেন। এ ছাড়া তার উদ্যোগগুলোর মধ্যে ‘অমরপুর আশ্রয়ণ মসজিদ’ নির্মাণ, পরিষদ চত্বরের সকল কোয়ার্টার মেরামত ও সংস্কার, অফিস ও কনফারেন্স রুম ডেকোরেশন, পরিষদ চত্বর সিসিটিভি’র আওতায় আনা,  ‘শেখ রাসেল শিশু পার্ক’ নির্মাণ (বাস্তবায়নাধীন) উল্লেখ্যযোগ্য।

সাপাহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন কিছু সৃষ্টি করতে সব সময় ভালো লাগে। তাই সৃষ্টিসুখের উল্লাসে এই উপজেলাকে ব্র্যান্ডিং করতে যা যা করা প্রয়োজন প্রতিনিয়ত তা করার চেষ্টা করেছি। সকলে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করেছেন বলেই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। সাপাহারকে মডেল উপজেলা হিসেবে বিনির্মাণ ও পরিচিত করতে গিয়ে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সেই সম্পর্কের জায়গা থেকেই বিদায় বেলায় তারা কেঁদেছেন।

আরমান হোসেন রুমন/এমজেইউ