২০০ বছরের ঐতিহ্য আঁকড়ে আছে চার প্রজন্ম
ঘরে ঘরে এখন বৈদ্যুতিক ইস্তিরি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে ধোপা পেশা। এখন আর পিতলের তৈরি ইস্তিরি মেশিন নেই বললেই চলে। নেই কাপড় ধৌতকরণ, চলে শুধু কয়লার ইস্তিরি। কিন্তু কুমিল্লার চৌধুরীপাড়ায় দুই শতাব্দী আগের বাবা-দাদার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন ১৮ থেকে ২০টি ধোপা পরিবার। তারা এখনো পিতলের ইস্তিরি মেশিন কাজ করেন কায়লার আগুনে।
স্থানীয় সূত্রমতে, কয়েক শতাব্দী ধরে গোমতীর কোল ঘেঁষে শুরু হয়েছিল নমশূদ্র পরিবারের বসবাস। শহরের আবাসিক এলাকা ও জমিদারবাড়ির লোকদের পোশাক ধৌত করার দায়িত্ব নেন নমশূদ্র বংশীয়রা। নগরীর পুরাতন চৌধুরীপাড়ায় তারা বসবাস শুরু করেন। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধোপা পেশাকে ধরে রেখেছেন তিন-চার প্রজন্ম। ২০০ বছরের বেশি সময় টিকে থাকা এ পেশা এখনো আপন ঐতিহ্যে চলছে কাঠের কয়লা আর পিতলের ইস্তিরিতে। তবে কাঠের কয়লার মেশিন এখন বিলুপ্তির পথে।
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে একই পরিবারের ১১ জন এ পেশায় আছেন। মনিলাল ধোপার ছেলে শুভ লাল ধোপার মৃত্যুর পর ছয় ছেলে অনক, কিশোর, চন্দন, সুমন, রুবেল ও প্রদীপ ধোপা পেশায় আছেন। তারা শহর ও শহরতলিতে দোকানে বসেন। তাদের স্ত্রীরা বাসায় বাসায় ধোপার কাজ করেন।
ধুপী শ্যামলা রানী দাস। বৃদ্ধ এ নারী বাসা থেকেই ধোপার কাজ করেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, জয় বাংলার পর (স্বাধীনের পর) এ পেশা শুরু করি। আমার স্বামী বালু লাল দাস, শ্বশুর চন্দ্র লাল দাস, দাদাশ্বশুরও এ পেশায় ছিলেন। আমার বাবা ও দাদা ধোপা ছিলেন। এখন আমার ছেলে শিমুল চন্দ্র দাস একই পেশায় আছে। আমি যে কয়লার ইস্তিরি মেশিনটা ব্যবহার করি, এটি শ্বশুরের। করাচি থেকে আনা হয়েছে, যা ডাবল সিংহ মার্কা পিতলের মেশিন। এটি এখন পাওয়া যায় না। চট্টগ্রাম থেকে পিতলের আয়রন মেশিন পাওয়া যায়, কিন্তু বেশি দিন টেকে না। লোহার মেশিন ভালো না। একটা পিতলের মেশিন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা।
বিজ্ঞাপন
ধুপী মোকেশ চন্দ্র দাস বলেন, ছোটকাল থেকেই এ পেশায় জড়িত। আমার বড় ভাই সন্তোষ চন্দ্র দাসও এ কাজ করেন। বাবা বুলবুল চন্দ্র দাস, দাদা গোবিন্দ চন্দ্র দাসও এ পেশায় ছিলেন। আগের মতো চাহিদা নেই, ঘরে ঘরে বৈদ্যুতিক ইস্তিরি আছে। এখন দিনে ৪০০ টাকা আয় করতে কষ্ট হয়। কাপড় ধোয়ার কাজ তেমন আসে না, শুধু ইস্তিরির কাজ। এ টাকায় পরিবার চালাতে কষ্ট হয়।
মদন চন্দ্র দাস বলেন, আমার দাদা জানু লাল ধুপী ও পিতা বিহারী লাল দাস এ পেশায় ছিলেন। তবে আমার ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা করে, তারা এ পেশায় থাকবে না।
লেখক ও প্রবীণ সাংবাদিক খাইরুল আহসান মানিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, চৌধুরীপাড়া-সংলগ্ন ডেলনি হাউসে জমিদারদের বসবাস ছিল। মোগলটুলি ফারুকী হাউসে নওয়াব স্যার কে জি এম ফারুকী থাকতেন। গোমতী নদীতে তখন বড় নৌযান চলাচল করত। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী এলাকার জমিদাররা কুমিল্লা শহরমুখী ছিলেন। তাদের প্রয়োজনে তারা ধোপা, নাপিত, জেলে, কামারদের থাকা ও কাজের ব্যবস্থা করে দিতেন।
তিনি আরও বলেন, ধোপার কাজ করার জন্য প্রচুর পানির দরকার। গোমতী নদীর পানিতে তারা কাপড় ধোয়ার কাজটি করতেন। সে কারণেই গোমতীপাড় পুরাতন চৌধুরীপাড়ায় তাদের বসবাস। যুগের পর যুগ এখানে এ পেশা টিকে থাকার কারণ চৌধুরীপাড়া আবাসিক এলাকা।
স্থানীয় বাসিন্দা আইনজীবী কাজী আসিফ আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ধারণা করা হচ্ছে তাদের পূর্বপুরুষরা প্রায় ৪০০ বছর আগে এখানে বসবাস শুরু হয়। তারা হিন্দি ও উর্দুর মিশ্রণে ভোজপুরি ভাষায় কথা বলতেন। এখন বাংলা ব্যবহার করেন। তবে ধোপা পেশার লোকজন দিন দিন কমে যাচ্ছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ বছর পর এ পেশা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাদের পরের প্রজন্ম চাকরি, ব্যবসা বা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
এনএ