বরগুনায় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ডায়রিয়া

মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বিপর্যস্ত পুরো দেশ। টানা লকডাউনে ঘরবন্দি দেশের মানুষ। প্রতিদিন করোনায় আক্রান্তের পাশাপাশি মুত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। করোনাভাইরাসের এই ভয়াবহতার মধ্যেই বরগুনায় মারাত্মক রূপ নিয়েছে ডায়রিয়া। এক সপ্তাহে জেলায় ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১৩শ জন।

গত এক যুগ বা তারও বেশি সময়ের মধ্যে বরগুনায় ডায়রিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে মারত্মক আকার ধারণ করেছে। ২০২১ সালে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বরগুনায় এখন পর্যন্ত কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও ডায়রিয়ায় ইতোমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন দুইজন। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে বেগ পেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের।

জেলা সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীতে ভরে গেছে। বিপুল পরিমাণ রোগীর কারণে দেখা দিয়েছে ওষুধ সংকট। পরিস্থিতি সামাল দিতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সমাজের সামর্থবানরা। এক প্রকার তাদের দয়ায় চলছে বিপুল পরিমাণ ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসা।

জেলা সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীতে ভরে গেছে

বরগুনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পরিসংখ্যানবিদ জেলিয়া ইয়াসমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইতোমধ্যেই বরগুনায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুজন মৃত্যুবরণ করেছেন। গত এক সপ্তাহে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ২৯২ জন। তার মধ্যে সদর উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪৭৪ জন, বেতাগীতে ৩৪৮ জন, আমতলীতে ২৩১ জন, বামনায় ১০৭ জন এবং পাথরঘাটা উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৩২ জন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩২১ জন।

বরগুনা সদর হাসপাতালের পরিসংখ্যানবিদ মো. আল-আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বরগুনা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৯ জন। এছাড়াও গত সাত দিনে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন ৩২০ জন। আর গত এক মাসে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯২৮ জন। বর্তমানে নয়টি বেডের অনুকূলে বরগুনা সদর হাসপাতালে ৮০ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি আছেন বলেও জানান তিনি।

 ডায়রিয়ায় প্রাণ হারিয়েছেন দুইজন

বরগুনা জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক খান মুহাঃ সালামাত্ উল্লাহ্ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের ভয়াবহতার থেকেও বরগুনায় ডায়রিয়ার প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এখন পর্যন্ত বরগুনায় করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ১৮১ জন। আর এই পরিমাণ মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে গত এক সপ্তাহে। 

তিনি আরও বলেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর কারণে জেলা সদর হাসপাতালসহ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেগুলোতে তিল ধারনের ঠাঁই নেই। বিপুল পরিমাণ ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন খোদ চিকিৎসকরাও।

ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মদন মোহ দাশ (৬৫) ঢাকা পোস্টকে জানান, তিনি একজন নিরামিষভোজী। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার মতো কোনো খাবার তিনি খাননি। তারপরও তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বরগুনা সদর হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সবুজ (২৫) নামে এক যুবক ঢাকা পোস্টকে জানান, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার মতো কোনো খাবার তিনি খাননি। তবে খালের পানিতে গোসল করেছিলেন। এরপর গতকাল রাত থেকে তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন।

ডায়রিয়ায় আত্রান্ত রোগীদের জন্য কোনো ওষুধ এখন আর মজুত নেই

বরগুনা সদর হাসপাতালের স্টোর কিপার জসিম উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বরগুনায় ডায়রিয়ার প্রকোপ এতোটাই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে যে রোগীর চাপে সব ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আত্রান্ত রোগীদের জন্য কোনো ওষুধ এখন আর মজুত নেই। তাই বিভিন্ন দফতর ও মানুষের কাছ থেকে এক প্রকার ভিক্ষা করে আমরা হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছি। 

বরগুনা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের স্টোর কিপার মো. আমিনুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বরগুনায় ডায়রিয়ার প্রকোপ করোনার থেকেও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে হাসপাতালসহ কয়েকটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডায়রিয়া রোগীদের জন্য মজুত ওষুধ ফুরিয়ে গেছে। তাই সেসব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক প্রকার ভিক্ষা করে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাচ্ছেন সেখানকার কর্মীরা।

তিনি আরও বলেন, গতকাল বরগুনায় এক হাজার মিলিলিটারের তিন হাজার ও পাঁচশ মিলিলিটারের চার হাজার ব্যাগ স্যালাইন বরাদ্দ এসেছে। বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজে যোগাযোগ করে এই স্যালাইনের বরাদ্দ এনেছেন। তাই সেই স্যালাইন তার সংসদীয় আসনের বামনা, বেতাগী ও পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে বরগুনা জেলার জন্য পাঁচ হাজার মিলিলিটার স্যালাইন বরাদ্দ দেওয়া হবে বলে শুনেছি। তবে তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারিনি।

এ বিষয়ে বরগুনার সিভিল সার্জন ডা. মারিয়া হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বরগুনায় উদ্বেগজনকহারে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। অনাবৃষ্টির ফলে পানি দূষণের কারণে জেলায় বিপুল পরিমাণ মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের স্যালাইন সংকট থাকলেও এই মুহূর্তে তা কিছুটা সমাধান হয়েছে। গ্রামসহ সর্বত্র মানুষকে ডায়রিয়ার বিষয়ে সচেতন করতে স্বাস্থ্য বিভাগ প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। 

সাইফুল ইসলাম মিরাজ/আরএআর/জেএস