বিস্ফোরণে ধসে পড়ে ভবনের দেয়াল

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি বহুতল আবাসিক ভবনের ফ্ল্যাটে গ্যাসের চুলার লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে নারী ও শিশুসহ ১১ জন দগ্ধ হয়েছেন। বিস্ফোরণে ওই ফ্ল্যাটের এক পাশের দেয়াল উড়ে গিয়ে পাশের ভবনের ছাদে গিয়ে পড়েছে। বিস্ফোরণের পর আগুনে পুড়ে গেছে ফ্ল্যাটের মালামাল। 

শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) ভোরে ফতুল্লা থানার পশ্চিম তল্লা এলাকায় মডেল গার্মেন্টসের দক্ষিণ পাশে স্থানীয় মফিজুল ইসলামের বাড়ির তৃতীয় তলার ফ্ল্যাট বাসায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভানোসহ দগ্ধদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। দগ্ধদের মধ্যে ছয়জনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। অপর পাচঁজনকে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে (ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল) চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। 

এদিকে ভবনটিতে ফাটল ধরে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় বাড়ির বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় মলামাল নিয়ে বের করে দিয়ে ভবনটি সিলগালা করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। একই সঙ্গে বিস্ফোরণের কারণে অনুসন্ধানে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রহিমা খাতুনকে প্রধান করে সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। 

নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন জানান, পশ্চিত তল্লা এলাকার মফিজুল ইসলামের বাড়ির তৃতীয় তলায় বেশ কয়েকটি পরিবার বসবাস করেন। এসব পরিবারের সদস্য গার্মেন্টসসহ ভিন্ন কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল। রাতে একটি পরিবারের লোকজন চুলার বার্নার বন্ধ না করেই ঘুমিয়ে পড়েন। এতে চুলা থেকে গ্যাস বের হয়ে রান্নাঘরসহ অন্যান্য ঘরে ছড়িয়ে জমাট বেঁধে থাকে। 

ভোরে রান্নার জন্য চুলায় আগুন জ্বালালে নির্গত গ্যাস থেকে মুহূর্তের মধ্যে পুরো ঘরে আগুন ধরে যায় এবং বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে গ্যাস সংযোগের রাইজারসহ আগুন ধরে যায়। এ সময় এক শিশুসহ ছয়জন নারী ও চারজন পুরুষ আগুনে দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে শিশুটিসহ ছয়জনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হয় এবং পাচঁজনকে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিস্ফোরণে রান্না ঘরের পাশের দুটি রুমের দরজা, জানালা ও দেয়াল ভেঙে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে নিচে এবং পাশের একটি ভবনের ছাদে গিয়ে ছিটকে পড়েছে। ঘরের আসবাবপত্র, বিছানা, তোষক, বালিশসহ সব পুড়ে গেছে। রান্নাঘরের চুলায় বসানো ছিল ভাতের পাতিল। চুলার লোহা ছুটে এলোমেলা হয়ে গেছে। এছাড়াও বিস্ফোরণের কারণে ওই ভবনের অন্যন্য রুমের দরজা-জানালা ভেঙে ঘরের ভেতর গিয়ে পড়েছে। 

প্রত্যক্ষদর্শী আল আমিন বলেন, ভোর ৬টার দিকে বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। চেঁচামেচি ও চিৎকারের শব্দ শুনে গিয়ে দেখি বাড়ির নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত আগুন জ্বলছে। পরে আশপাশের লোকজনের সহায়তায় বালুর বস্তা দিয়ে গ্যাসের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। কিন্তু ততক্ষণে ওই ঘরে ভেতরে থাকা দুটি পরিবারের প্রায় ১১ জন সদস্য আগুনে দগ্ধ হন। 

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সোলায়মান মিয়া বলেন, আগুনে দগ্ধদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাই। দগ্ধদের মধ্যে একজন নারী ও শিশুর অবস্থা খুবই খারাপ দেখেছি। তাদের শরীরের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ঝলসে গেছে।  

প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল্লাহ বলেন, হঠাৎ ঘুমের মধ্যে বিকট আওয়াজ শুনে উঠে পড়ি। দেখি একটি দরজা উড়ে এসে আমার ওপর পড়েছে। 

এলাকাবাসী জানান, শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে নারায়ণগঞ্জে গ্যাস নির্গত হয়ে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু মানুষকে সচেতন করার জন্য তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সম্প্রতি ফতুল্লার মাসদাইরে তালা ফ্যাক্টরি এলাকায় গ্যাসের লিকেজের আগুনে দগ্ধ হয়ে পাচঁজন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও তল্লা মসজিদে গ্যাসের লিকেজের বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে ৩৪ জন মুসল্লি মারা গেছেন। রাতের বেলা ঘুমানোর আগে যদি ভালোভাবে গ্যাসের চুলার বার্নার বা চাবি বন্ধ করে রাখা হয় তবেই এসব দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচা সম্ভব। 

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোসাম্মৎ রহিমা আক্তারকে প্রধান করে সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্য হিসেবে সদর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন, বিদ্যুৎ বিভাগসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।     

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরা বলেন, গ্যাসের লিকেজের আগুনে বিস্ফোরণ ঘটে। একজন নারীকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে রাখা হয়েছে। শিশুসহ ওই নারীর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের চিকিৎসার জন্য কোনো আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন হলে উপজেলা প্রশাসন থেকে করা হবে। বিস্ফোরণের কারণে তিনতলা বাড়ির বিভিন্ন দেয়ালে ফাটল দেখা দেওয়ায় ভবনটি সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। 

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্টিবিউশন কোম্পানির ফতুল্লা অঞ্চলের ম্যানেজার প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম বলেন, ধারণা করা হচ্ছে গ্যাসের চুলা চাবি ছাড়া ছিল। অথবা চাবি লুজ থাকার কারণে গ্যাস নির্গত হয়ে জমাট বেঁধে ছিল। ভোরে রান্না করার জন্য ম্যাচের কাঠি দিয়ে চুলা ধরানোর সময় আগুন ধরে বিস্ফোরণ ঘটে। তবে আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি গ্যাসের পাইপে কোনো লিকেজ বা রাইজারে কোনো সমস্যা ছিল না। তারপরও তদন্ত করে দেখা হবে কী কারণে বিস্ফোরণ ঘটেছে। 

তিনি বলেন, গ্যাসের লিকেজের কোনো অভিযোগ পেলে তৎক্ষণিকভাবে তা মেরামত করা হয়। সচেতনতার অভাবে অনেকেই গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখেন বা চুলা বন্ধ না করেই ঘুমিয়ে পড়েন। এসব কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। 

রাজু আহমেদ/আরএআর