নওগাঁয় শ্রমিক সংকটে মাঠেই ঝরছে কৃষকের ধান
দেশের শস্য ভান্ডার খ্যাত নওগাঁয় এখন ধান কাটার মৌসুম। জেলার চারপাশে ফসলের মাঠে দুলছে পাকা ধান। প্রায় চার মাস আগে অক্লান্ত পরিশ্রম করে কৃষকরা যে ধান রোপণ করেছিলেন এখন সেই ধান ঘরে তুলতে পারবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত কৃষি শ্রমিকের অভাবে মাঠেই ঝরে পড়ছে কৃষকের কষ্টের ফসল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, নওগাঁয় ধান পেকে যাওয়ায় পুরোদমে কাটা-মাড়াই শুরু হলেও লকডাউনের কারণে জেলার বাইরে থেকে কৃষি শ্রমিকরা আসতে পারছেন না। এতে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। পাকা ধান মাঠ থেকে কেটে ঘরে তুলতে না পারায় ঝড়-বৃষ্টিতে ধানের ক্ষতির আশঙ্কায় চরম উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন বোরো চাষিরা। স্থানীয় শ্রমিক দিয়ে ধান কাটা-মাড়াইয়ে খরচও বেশি পড়ছে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
বিজ্ঞাপন
যদিও নওগাঁ জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলার বাহির থেকে কৃষি শ্রমিক নিয়ে আসার উদ্দোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আশানুরুপ কৃষি শ্রমিক আসেননি। জেলায় বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ে স্থানীয় প্রায় সাড়ে তিন লাখ শ্রমিক ছাড়াও জেলার বাইরের শ্রমিকের প্রয়োজন এক লাখ পাঁচ হাজার। এর বিপরীতে গত কয়েকদিনে জেলায় বাহিরের কৃষি শ্রমিক এসেছে মাত্র পাঁচ হাজার। যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য।
আত্রাইয়ের মালিপুকুর এলাকার ধানচাষি জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনি এ বছর ১৫ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন। কিন্তু ধান পেকে যাওয়ার পরও জেলার বাইরের শ্রমিক না আসায় ও ঝড়-বৃষ্টিতে ধানের ক্ষতির আশঙ্কায় বাধ্য হয়ে প্রতি বিঘা চার হাজার টাকা দিয়ে পাকা-আধা পাকা ধান কেটে ঘরে তুলেছি।
বিজ্ঞাপন
দিনাজপুরের বিরল এলাকা থেকে আসা কৃষিশ্রমিক আজহারুল ইসলাম বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার নওগাঁয় আসতে যানবাহনের ভাড়া দ্বিগুণ লেগেছে। এ কারণে স্বভাবিকভাবে মজুরি ৫০০-১০০০ টাকা বাড়বে। বর্তমানে আমরা চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা দরে প্রতি বিঘা জমির ধান কাটছি।
নওগাঁ সদরের দিঘলীর বিল এলাকার বোরো ধান চাষি বাবলু প্রমাণিক বলেন, এখন পর্যন্ত বাহিরের শ্রমিক না আসায় প্রতি বিঘায় ৫০০ টাকা বেশি মজুরিতে স্থানীয় শ্রমিক দিয়ে ধান কাটতে হচ্ছে। বর্তমানে জেলার হাটবাজারে প্রতি মণ ভেজা ধান ৯০০ থেকে ১০৫০ টাকা দরে বেচাকেনা হচ্ছে। তবে ধানের দাম এর নিচে এলে বোরো চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফর নওগাঁর উপপরিচালক সামশুল ওয়াদুদ জানান, জেলায় বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ে মোট সাড়ে চার লাখ কৃষিশ্রমিকের প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ শ্রমিক বাদ দিয়ে জেলার বাইরের কৃষিশ্রমিক প্রয়োজন এক লাখ পাঁচ হাজার। কিন্তু করোনা সংক্রমণ রোধে লকডাউনের কারণে বাস, ট্রেন ও অন্যান্য গণপরিবহন বন্ধ থাকায় নওগাঁয় আসতে পারছেন না গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোরসহ বিভিন্ন জেলার শ্রমিকরা।
তিনি আরও জানান, বোরো চাষিদের যোগাযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের বিশেষ ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে গত কয়েকদিনে মাত্র পাঁচ হাজার শ্রমিক জেলায় ধান কাটতে এসেছেন। বাইরে থেকে আসা শ্রমিকরা বলছেন- এবার বাস কিংবা মাইক্রোবাসযোগে নওগাঁয় আসতে দ্বিগুন ভাড়া গুনতে হচ্ছে। এ কারণে বোরো চাষিদেরও গত বছরের চেয়ে প্রতি বিঘা ধান কাটা-মাড়াইয়ে ৫০০-১০০০ টাকা অতিরিক্ত লাগছে। জেলায় ৮৭টি হারভেস্টার মেশিন দিয়ে মাত্র তিন হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা-মাড়াই সম্ভব হবে।
জেলায় এ বছর ১ লাখ ৮০ হাজার ৬২৪ হেক্টর জমিতে বোরো ধান রোপণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু রোপা আমনে ভালো দাম পাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত আরও সাড়ে ৭ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান রোপণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলার বিভিন্ন স্থানে ধান কাটা-মাড়াই শুরু হয়েছে। এবারে ধানের ফলন খুব ভালো। প্রতি বিঘায় ২০ থেকে ২৫ মণ ধান পাওয়া যাচ্ছে। কোনো প্রাকৃতিক দুযোর্গ না হলে এবং সময় মত ধান ঘরে তুলতে পারলে প্রায় ১২ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হবে বলে আশা কৃষি বিভাগের। প্রতি মণ নতুন ধান বাজারে ৯০০-১০৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার পাহাড়পুর এলাকার বোরো ধানচাষি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, এবার গত বছরের চেয়ে বোরোর ফলন ৪-৫ মণ বেশি হচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় শ্রমিক না থাকায় পাকা ধান কেটে ঘরে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। সময়মতো জেলার বাহিরের শ্রমিক না এলে বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ে চাষিদের বিড়ম্বনাসহ ঝড়-বৃষ্টিতে আর্থিক ক্ষতি হতে পারে।
নওগাঁর পুলিশ সুপার প্রকৌশলী আব্দুল মান্নান বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়ে আসা বাহিরের শ্রমিকদের আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। পাশাপাশি জেলার শ্রমিকদের এক থানা থেকে জেলার অন্য থানায় পুলিশ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছে।
শামীনূর রহমান/আরএআর