স্বামী নিল বাঘে, ঘর নিল আইলা
বাঘের আক্রমণে নিহত আব্দুল গফ্ফার খানের স্ত্রী রোকেয়া বেগম
খুলনার শাখবাড়িয়া নদীঘেঁষা উপজেলা কয়রা। একপাশে বিশাল সুন্দরবন অন্যপাশে সুন্দরবনকে আঁকড়ে বেঁচে থাকতে চাওয়া এক বিশাল জনপদ। সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে যাদের অধিকাংশের জীবিকা নির্বাহ হয়।
বন থেকে কাঠ, মধু কিংবা নদী থেকে মাছ সংগ্রহ করে কোনোরকম চলে তাদের জীবন। এ সুন্দরবনেই হাজারও মানুষের ভরসা। তবে সুন্দরবন যে শুধু দিয়ে যায় তা নয়, কখনো কখনো সর্বস্ব কেড়ে নিতে একটুও যেন দ্বিধা করে না।
বিজ্ঞাপন
আর তা ভালো করেই জানেন ৬ নম্বর কয়রার বাসিন্দা রোকেয়া বেগম, গোলজান বিবি, রীনা গাইন, উত্তর বেদকাশি গ্রামের নাসিমা বেগম ও ৫ নম্বর কয়রা গ্রামের হাসিনা খাতুনসহ শতাধিক নারী।
যারা প্রত্যেকে তাদের প্রিয়জন হারিয়েছেন। জীবিকা উপার্জনের জন্য সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের হামলায় হারিয়েছে প্রাণ। কখনো দেহাবশেষ ফিরেছে বাড়ি, আবার কখনো মিলে না হদিস।
বাঘের হামলায় নিহত আব্দুল গফ্ফার খানের স্ত্রী রোকেয়া বেগমের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী শেষবার যখন জঙ্গলে যায় তখন পাটা (মাছ ধরার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা জাল) জাল নিয়ে মাছ ধরতে গেছিলো। আট দিনের পাশ নিয়ে জঙ্গলে গেছিল আমার স্বামী আর অন্য একজন।’
বিজ্ঞাপন
রোকেয়া বেগম আরও বলেন, ‘জাল দিয়ে নদীতে মাছ ধরার সময় বাঘ আক্রমণ করে তাদের উপরে, বাঘ এসে স্বামীর ঘাড়ের উপরে হামলে পড়ে। বাঘ স্বামীর গলায় কামড় দিয়ে নৌকা থেকে নামিয়ে নেয় ও বনের ভেতরে নেওয়ার চেষ্টা করে।’
তিনি বলেন, তখন কাদামাটি চোখে লাগলে বাঘ স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। অন্যদিকে ততক্ষণে হাকাহাকি (চিৎকার) শুনে অন্য জেলেরা এগিয়ে এসে আমার স্বামীকে উদ্ধার করে। তবে তাকে আর বাঁচানো যায়নি, ওখানেই মারা যায়। ২০০৮ সালে স্বামীকে খাইলো বাঘে আর ২০০৯ সালে বসতভিটা নিল ঘূর্ণিঝড় আইলাতে।’
‘স্বামী হারানোর পরে কোনো দিশা না পেয়ে চলে যাই বাপের বাড়ি। কিছুদিন পরে বাড়ি ফিরে দেখি আইলায় নিজেদের থাকার ঘরটাও শেষ। আমার তখন এক ছেলে আর এক মেয়ে। সে সময় কিছু এনজিওর সহায়তায় এবং নিজে কাজ করে এই ঘরটা করছিলাম।’ বলেন তিনি।
স্বামী হারানো রোকেয়া বেগমের জীবন থেমে থাকেনি। আইলার পরে সে সংগ্রাম হয়তো বেড়েছে তবে জীবন চালিয়ে নিতে সব বাঁধার সঙ্গে কঠোর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন তিনি। স্বামীর দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির পর ‘অপয়া’ ‘অলক্ষ্মী’ কিংবা ‘হতভাগী’ অপবাদেও থেমে যাননি তিনি।
দুই ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া করানোর জন্য সবচেষ্টা তিনি করছেন। শিখেছেন সেলাই মেশিনের কাজ, পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের সহায়তা পান তিনি, তবে তা খুব কম। রোকেয়া বেগম স্বপ্ন দেখেন ছেলে-মেয়ে একদিন শিক্ষিত হয়ে হয়তো তার কষ্ট লাঘব করবে।
বাঘ কেন জেলে কিংবা মৌয়ালদের উপরে এমন হামলে পড়ে? এমন প্রশ্নের উত্তরে বাঘ গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাঘ পুরো সুন্দরবনে আছে ফলে যখন জেলে-মৌয়ালরা প্রবেশ করে তখন আক্রমণের শিকার হয়।’
অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান আরও বলেন, এক্ষেত্রে পশ্চিম সুন্দরবন অর্থাৎ সাতক্ষীরা অঞ্চল ও পূর্বখুলনায় বেশি আক্রমণের শিকার হন তারা। এখন সুন্দরবনে মোট শতাধিক বাঘ রয়েছে।
বাঘের আক্রমণে নিহত ব্যক্তিদের স্ত্রী ‘বাঘ বিধবা’ নামে পরিচিত। তাদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট (আইসিডি) নামের একটি সংগঠনটি।
সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা মো. আশিকুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৪৫ জন ‘বাঘ বিধবা’র তথ্য আমাদের কাছে আছে, তবে প্রতিনিয়ত এর সংখ্যা বাড়ছে। ৪০ জনকে আমরা সহায়তা করতে পেরেছি। সীমাবদ্ধতার কারণে বাকিদের এখনও সহায়তা করতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, তবে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন আমাদের পাশে দাঁড়ালে আমরা তাদের জন্য আরও কিছু করতে পারব। আমাদের বাইরে অন্য কোনো সংগঠন তাদের নিয়ে কাজ করছে না। আমরা চাইব যাতে এসব অসহায় নারী কিংবা পরিবারের জন্য সবাই যেন এগিয়ে আসেন।
এমএসআর