একটি রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করেন মো. লিটন। সামান্য উপার্জনে ভালোই চলছিল তার পরিবার। সুখের সংসারের স্বপ্ন বুনে দুই বছর আগে বিয়েও করেছেন তিনি। কিন্তু নতুন বউয়ের হাতের মেহেদির রং শুকানোর আগেই নেমে আসে করোনার থাবা। ফিকে হতে থাকে তার রঙিন স্বপ্ন। অভাব উঁকি দেয় পরিবারে। করোনার প্রথম দিকে টানা লকডাউনের সময় পরিচিত ও স্বজনদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে চালিয়েছেন সংসার। কিন্তু এখন জমানো কিছু টাকা ছাড়া আর কোনো পথ দেখছেন না তিনি।

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার কলকলিয়া ইউনিয়নের জগদিশপুর গ্রামের হোটেল-শ্রমিক মো. লিটন মিয়ার বর্তমান অবস্থা এমন। শুধু লিটন কেন, সারাদেশের মতো এ জেলার অন্য শ্রমিকরাও এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন বলে জানা যায়।

আজ মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস বা মে দিবস। সারাদেশের শ্রমিকরা প্রতিবছর এই দিবস পালন করেন বঞ্চনা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। কিন্তু এবার এমন এক সময়ে দিবসটি এল, যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সারা দেশের মতো সুনামগঞ্জ কঠোর লকডাউনের বিধিনিষেধের চাদরে মোড়া।

এদিকে দোকান ও শপিংমল খুললেও এখন বন্ধ রয়েছে রেস্টুরেন্ট। এতে রেস্টুরেন্টে কাজ করা শ্রমিকরা পড়েছেন সবচেয়ে কষ্টের মধ্যে। অনেক শ্রমিক ইতোমধ্যে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এতে তাদের জীবন-জীবিকায় নেমে এসেছে নিদারুণ কষ্ট।

‘এক মাসের ওপর হয়েছে কোনো বেতন পাই না। বেতন না পাইলে চলাও সম্ভব নয়। এখন হাত পাতব, সে মানুষও নেই। সবারই এক অবস্থা; হাত খালি। তারাই টেনেটুনে সংসার চালাইতাছে।‘ বলছিলেন হোটেল-শ্রমিক মো. লিটন মিয়া।

ঢাকা পোস্টকে জানান, অনেক সময় ধারদেনাও করেছেন। পরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আবারও হোটেলে কাজ করে পরিবারের হাল ধরেন। কিছু ঋণ পরিশোধও করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় দফার লকডাউনে হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ হওয়ায় পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি।

লিটন মিয়া বলেন, হোটেলে সামান্য বেতনে এমনিতেই পোষায় না। ওয়েটারের কাজ করি। সার্ভিসে খুশি হয়ে মানুষ বকশিশ দেয়। এই টাকায় পরিবার কোনো রকম চলে যায়। দ্বিতীয় দফায় লকডাউনের সময় অনেক দিন না খেয়ে ছিলাম। লজ্জায় মানুষের কাছে হাত পাততে পারি না। নিজের একটা গরু ও একটা ছাগল ছিল। গরুটাকে বেচার বয়স হয়নি। তবু ১৬ হাজার টাকা দিয়ে বিক্রি করেছি। আর ছাগলটা সাড়ে ৩ হাজার টাকায়। এই সাড়ে ১৯ হাজার টাকায় পরিবার চালাইতাছি এখন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ হোটেলশ্রমিক রয়েছেন। তাদের মধ্যে কারিগর, বাবুর্চি, ওয়েটার ও মেনেজার রয়েছেন। বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাবে লকডাউনে সব রকমের হোটেল বন্ধ হওয়ায় বেতনও পাচ্ছেন না তারা। অনেকের লকডাউনের আগে থেকেই বেতন বন্ধ। এদিকে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে গত ২৫ এপ্রিল থেকে দোকান ও শপিংমল খুলে দিয়েছে সরকার।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামের বাসিন্দা মো. মানিক মিয়া। তিনি শহরের মৌল্লার হোটেলের বাবুর্চি। তার দুই মেয়ের একজন সুমাইয়া আক্তার শিমু সুনামগঞ্জ শহর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। আরেকজন পিটিআই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সঙ্গে বৃদ্ধ মা থাকেন। তার পাঁচ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। পরিবারের সম্পূর্ণ চাহিদা পূরণ করতে না পারলেও হোটেলের বাবুর্চির কাজ করেই সংসার চালান। এমনিতেই খেতে হয় হিমশিম। তার ওপর লকডাউনে হোটেল বন্ধ। এক চরম আর্থিক সংকটে পড়েছেন তিনি।

মানিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাচ্চাকাচ্চা এখন বড় হয়েছে। চাইলেই মানুষের কাছে হাত পাততে পারি না। লকডাউনে হোটেল বন্ধের সঙ্গে আমাদেরও বেতন বন্ধ হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এ পর্যন্ত কারও কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাইনি। পরিবার নিয়ে আছি সমস্যায়। কাউকে কিছু বলতেও পারছি না।

কারিগর কাজল বলেন, আমি সিলেটের আল-মদিনা হোটেলে কাজ করতাম। হোটেল বন্ধ হওয়ায় পর অনেক শ্রমিককে ছাঁটাই করেছেন মালিক। আমাকেও ছাঁটাই করেছেন। কাজ হারিয়ে বাড়িতে আইছি। এখন বেকার। কিছু জমানো টাকা ছিল, সেটা ভেঙে চলতাছি। নিজের কিছু বেইচ্ছা দিমু, সে রকম কোনো সম্পদও নাই। এ রকম থাকলে কদিন পরে না খাইয়া থাকতে হইব।

এদিকে জেলা শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, এই লকডাউনে হোটেলের মালিক অনেক শ্রমিককে ছাঁটাই করেছেন। যে হোটেলে ৪০ জন শ্রমিক ছিলেন, সেখানে আছেন এখন ১০ জন। কারণ, মালিকের দোকান বন্ধ। এত শ্রমিকের বেতন দিতে পারবেন না। তাই বাধ্য হয়ে তারা এ রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

বাংলাদেশ হোটেল মিষ্টি বেকারি শ্রমিক ইউনিয়নের সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি মো. লিলু মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুরো জেলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ হোটেল মিষ্টি বেকারির শ্রমিক রয়েছেন। লকডাউনে সব বন্ধ। কারও বেতন হচ্ছে না। সামনে ঈদ। সবার বউ-বাচ্চা রয়েছে। তারা কীভাবে ঈদ করবে? সরকারের বিধিনিষেধ আমরা মেনেছি। কিন্তু আমাদের পরিবারগুলো যে রয়েছে, তাদের নিয়ে কীভাবে চলব, সেটা কেউ ভাবছে?

সরকার কয়েক দফায় লকডাউন দিয়েছে। অনেক সেক্টরের মানুষকে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু আমাদের জন্য কিছুই দেয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের শ্রমিকরা খেয়ে না-খেয়ে জীবন যাপন করছেন। সরকারের কাছে সুনামগঞ্জের হোটেল মিষ্টি বেকারি শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সুনামগঞ্জ পৌরসভার ভেতরে প্রায় ৭৫০ সেক্টরের শ্রমিকদের ত্রাণসহায়তা দিয়েছি। যারা পাননি, পরে তাদেরও দেওয়া হয়েছে। এই তালিকা করেছেন সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র। তবু কেউ যদি বাদ পড়েন, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা সহায়তা করব।

এনএ