সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আসছে সুরভী-১০
বরিশাল শহরের উপকণ্ঠের ব্যস্ততম খেয়াঘাট বেলতলা। তারই দুই পাশে সারাক্ষণ ইস্পাত, লোহা আর কাঠ কাটার শব্দ। চলছে নকশার কাজ। ধাতব পাতে পাত জোড়া লাগাতে চোখ ঝলসানো বিদ্যুতের উল্কা ছড়িয়ে পড়ছে ক্ষণে ক্ষণে। বারো মাসে একই চিত্র বেলতলা পাড়ের।
এখন খেয়াঘাটে দাঁড়ালে হাতের বাঁ পাশে চোখে পড়বে দৃষ্টিনন্দন একটি নৌ-যান। কর্মব্যস্ত সেখানকার শতাধিক শ্রমিক; দম ফেলার ফুরসত নেই। সবাই মিলে নির্মাণ করছেন দেশের সর্বাধুনিক লঞ্চ সুরভী-১০। দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী লঞ্চ কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম সুরভী শিপিং লাইন্স।
বিজ্ঞাপন
সোমবার (০৩ মে) দুপুরে বেলতলা ডকইয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, লঞ্চের নির্মাণকাজ শেষের দিকে। ঘষামাজা ও রঙের কাজ চলছে।
তিনতলায় কাজ করা মিস্ত্রি জানালেন, কাঠ, রঙ আর বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ শেষ হলেই নদীতে নামবে সুরভী-১০ লঞ্চ।
বিজ্ঞাপন
সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধা, চলাচলের উন্নত প্রযুক্তি যুক্ত করে ঈদের আগেই যাত্রী পরিবহনে যুক্ত হতে চায় সুরভী-১০। মূল কাঠামোর কাজ শেষ। এখন চলছে সৌন্দর্যবর্ধন আর প্রযুক্তিসমৃদ্ধ যন্ত্রপাতি যুক্ত করার কাজ।
সুরভী শিপিং লাইন্সের পরিচালক রিয়াজ উল কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, যত দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে কাজ করা যায়; তার সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। আমি সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছি। তত্ত্বাবধান করছি। আমার বিশ্বাস, নতুন করে নামানো লঞ্চটি সবার আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হবে। হাল আমলের যাত্রীদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে লঞ্চটি তৈরি করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৫ অক্টোবর ঢাকার সদরঘাটে নোঙর করে থাকা অবস্থায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয় সুরভী-৭ লঞ্চ। আগুন নেভানোর পর সেখান থেকে লঞ্চটিকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ ডকইয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। ৩০ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে আবারও লঞ্চে আগুন ধরে যায়। পরপর দুটি ঘটনায় হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও লোকসানের মুখে পড়ে সুরভী কোম্পানি।
ঢাকা-বরিশাল নৌ-পথে চলাচলকারী বিলাসবহুল সুরভী-৭ লঞ্চটি আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর হাসনাবাদ ডকইয়ার্ড থেকে বেলতলা খেয়াঘাটের ডকইয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় নতুন উদ্যমে ডিজাইনের কাজ। নিয়োগ দেওয়া হয় দক্ষ প্রকৌশলী। প্রায় ১৮ মাসের চেষ্টায় লঞ্চটিকে নতুন রূপে সাজানো হয়।
পরিচালক রিয়াজ উল কবির বলেন, সুরভী-৭ লঞ্চটিকে নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ছাড়া আর কোনো অবকাঠামো সুরভী-৭-এর নেই। সব কিছুই নতুন। ফলে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সুরভী-৭ নামে আর এটি নদীতে নামবে না। সুরভী-১০ নামে নিবন্ধন করা হবে। এই নামেই যাত্রা শুরু করবে সুরভী শিপিং লাইন্সের নতুন লঞ্চটি।
সুরভী-৭ লঞ্চটি তৈরি করতে যত টাকা ব্যয় হয়েছিল প্রায় সমান টাকা খরচ করে নামানো হচ্ছে সুরভী-১০ উল্লেখ করে রিয়াজ উল কবির বলেন, দিন দিন সব কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে। প্রতিদিন আপডেট হচ্ছে বিশ্ব। আমি একজন শিক্ষিত ব্যবসায়ী হিসেবে মনে করি, গতানুগতিক ধারায় ব্যবসা করা সম্ভব নয়; ব্যবসায়ীদের উচিতও না। সে দৃষ্টিকোন থেকে সুরভী-৭ লঞ্চের মূল অবয়ব ঠিক রেখে বাকি সব কিছু পরিবর্তন করে অত্যাধুনিকভাবে নির্মিত হয়েছে। আরও কয়েক মাস কাজ করতে হবে। তবে ঈদুল আজহার আগেই ঢাকা-বরিশাল নৌ-পথে যুক্ত হবে সুরভী-১০।
লঞ্চ কর্তৃপক্ষ জানায়, সুরভী-৭ লঞ্চটিতে ১৫০টি কেবিন ছিল। আর ডেকে ১৭০০ লোক যাতায়াত করতে পারতেন। সুরভী-১০ লঞ্চটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা আগের লঞ্চের। সে কারণে ধারণক্ষমতাও আগের মতোই।
রিয়াজ উল কবির আরও বলেন, লঞ্চে যাত্রীদের চলাচলের সুবিধার জন্য উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন লিফট যুক্ত করা হয়েছে। এতে রোগী ও যাত্রীরা দ্রুত সময়ের মধ্যে লঞ্চে ওঠানামা করতে পারবেন। লঞ্চের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিন মাস্টার ব্রিজ থেকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। রাতের অন্ধকার ও কুয়াশা ভেদ করে চলাচলের জন্য বসানো হয়েছে উন্নতমানের রাডার ও জিপিএস। নদীর ডুবোচর ও পানির পরিমাণ নির্ধারণ করে চলতে বসানো হবে ইকো সাউন্ডার এবং আপদকালীন সময়ে আশপাশের নৌ-যানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বসানো হয়েছে ভিএইচএফ রেডিও। সুরভী-১০ লঞ্চের চারপাশে যুক্ত করা হচ্ছে নেভিগেশন ক্যামেরা। যাত্রী নিরাপত্তায় সিসি ক্যামেরা থাকছে।
যাত্রীদের জন্য টেলিভিশন, এসি ও ফ্রি ওয়াইফাই থাকবে জানিয়ে পরিচালক কবির বলেন, যাত্রীসেবায় আধুনিক প্রশিক্ষিত টিম কাজ করবে। সরকারি সনদপ্রাপ্ত মাস্টার, সুকানি নিয়োগ করা হবে। যাতে সুরভী-১০ লঞ্চে ভ্রমণে যাত্রীদের কোনো সমস্যা না হয়।
রিয়াজ উল কবির আরও বলেন, অনলাইন টিকিটিং, লঞ্চে সরবারহকৃত বিদেশি খাদ্যের মান নিশ্চিত করা হবে। তবে ওষুধের দোকান রেখে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে চাই না আমরা।
তিনি বলেন, ফার্মেসি থাকতে হলে অবশ্যই একজন চিকিৎসক রাখতে হবে। যেহেতু চিকিৎসক পাওয়া যাবে না, তাই আমরা ফার্মেসি রাখব না। তবে প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধ লঞ্চ কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করবে। তবে লঞ্চের জগতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে সুরভী-১০।
এএম