কিডনি ডায়ালাইসিস করে গেল বুধবার (২৮ এপ্রিল) চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের কাদের বিশ্বাস বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে দেশে ফেরেন। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ রোধে যশোরের ম্যাগপাই হোটেলে ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন তিনি। কিনডি রোগী হওয়ায় ভারতীয় চিকিৎসকরা তাকে বেছে বেছে খাবার খেতে বলেছেন। স্বজনদের অভিযোগ, কোয়ারেন্টাইনে থাকায় হোটেলে কোন খাবার বেছে খেতে পারছেন না তিনি। ফলে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন তিনি। কাদের বিশ্বাসের মতো বেনাপোল দিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে চিকিৎসায় ভারতে গিয়ে ফেরা মানুষদের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে গিয়ে অর্থনৈতিক সংকটসহ নানা দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। 

তারা দাবি করছেন, এ অবস্থায় থেকে তারা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাদের চিকিৎসকের প্রয়োজন হলেও কোন সহায়তা পাচ্ছেন না। তারা নিজ নিজ এলাকায় কোয়ারেন্টাইনে থাকার দাবি করেছেন। 

জানা গেছে, ভারতে করোনার ব্যাপক সংক্রমণের কারণে গত ২৬ এপ্রিল থেকে দুই সপ্তাহের জন্য সীমান্ত পারাপার বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ সরকার। এ সময় বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি আটকা পড়েন ভারতে। তাদের ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপ-হাইকমিশন থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেশে ফিরতে হচ্ছে। দেশে ফেরার পর তাদের রাখা হচ্ছে যশোরের ২৯টি হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে। 

গত ২৬ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত বেনাপোল দিয়ে দেশে ফেরা দেড় হাজার বাংলাদেশিকে বেনাপোল ও যশোরের ২৯টি হোটেল ছাড়াও রাখা হয়েছে আশপাশের জেলাতেও। ভারতফেরত এসব যাত্রীরা বেশির ভাগ অসুস্থ। কোন না কোন জটিল রোগ নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। যারা কিছুটা সুস্থ ছিলেন, তাদের বেশির ভাগ ভারতে করোনা আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা যাওয়া দেখে ও রোগীদের সঙ্গে থেকে আতঙ্কিত ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের কিডনি রোগে আক্রান্ত কাদের বিশ্বাসের মা রহিমা বেগম। তিনিও হার্টের সমস্যা নিয়ে ছেলের সঙ্গে ভারত থেকে চিকিৎসা শেষে যশোর শহরের হোটেল ম্যাগপাইয়ে কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। তিনিও শোনালেন নানা সমস্যার কথা। তিনি জানান, তিনি নিজেই হার্টের রোগী। আর ছেলে কিডনি রোগী। দুজনই অসুস্থ। কিভাবে নিজেদের দেখভাল করব। ভারতের চিকিৎসক তরল খাবার খেতে বলেছে। আর ছেলেকে বেছে বেছে খাবার খেতে বলেছে। কিন্তু কোয়ারেন্টাইনে থাকাতে কিছুই হচ্ছে না। চিকিৎসকের প্রয়োজন হলেও কোন সহায়তা পাচ্ছেন না।  

খুলনার ডুমুরিয়ার সুমন সরকার জানান, মায়ের রানের হাড়ের সংযোগস্থলে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। ভারতে চিকিৎসায় প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন তার হোটেলে বাড়তি খরচ দিয়ে থাকার মতো অর্থ নেই। কিন্তু বাধ্য হয়ে তিনবেলা হোটেলে খাবার খরচ চালাতে গিয়ে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন।

ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের বর্ণা আক্তার জানান, তার ৫ বছরের অটিস্টিক শিশু সন্তানের চিকিৎসায় ভারতে গিয়েছিলেন। ছেলেকে সামলানো খুব কঠিন। এ কারণে স্বামী সন্তানসহ তারা ছয়জন ভারতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এতো মানুষ হোটেলে থাকা খাওয়ার ব্যয় বহনে তারা অসহায় বোধ করছেন। তাই নিজ নিজ এলাকায় কোয়ারেন্টাইনে রাখার দাবি করেন তিনি।


    
এদিকে কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের সেবা দিতে গিয়ে আতঙ্কের মধ্যে আছেন হোটেল কর্মীরা। এসব হোটেলের আশেপাশের বাসিন্দারাও ভয়ে রয়েছেন। 

ম্যাগপাই হোটেলের ব্যবস্থাপক আশিকুজ্জামান জানান, তাদের হোটেলে ২৭ জনকে রাখা হয়েছে। তাদের সেবা দিচ্ছেন তারা। কিন্তু তাদের জন্য কোন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। তারা তাদের মতো করে শুধু মাস্ক ব্যবহার করে কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের সেবা দিচ্ছেন। ফলে তারা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক হোটেল কর্তৃপক্ষ বলেন, লকডাউনের মধ্যে হোটেল ব্যবসা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। তার মধ্যে যশোরের হোটেলগুলো কোয়ারেন্টাইন বানানোর ফলে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে হোটেলে উঠছে না।

যশোরের সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন বলেন, ভারত থেকে ২৬ এপ্রিলের পর যারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন তাদের মধ্যে যারা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত তাদের আমরা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার করে দিচ্ছি। বাকিরা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে যশোর ও বেনাপোলের হোটেল ও ঝিকরগাছার গাজীর দরগাহ মাদরাসায় রয়েছেন। এ ছাড়া নড়াইলেও কিছু ভারতফেরত যাত্রীকে পাঠানো হয়েছে। এপ্রিল মাসে বেনাপোল দিয়ে ৩৫ জন করোনা রোগী দেশে ফিরেছেন। তাদের সকলকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

যশোর জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক ও জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান জানান, করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ রোধে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতে কঠোর রয়েছেন তারা। একইসঙ্গে কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টিও দেখছেন। ভারতফেরত যাত্রীদের যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ও আনসার মোতায়েন করা হয়েছে। ১৪ দিন পর করোনা নেগেটিভ সনদ প্রাপ্তি সাপেক্ষে এসব যাত্রীদের নিজ বাড়ির উদ্দেশে যেতে দেওয়া হবে। 

তিনি আরও বলেন, ভারত থেকে যে সংখ্যক পাসপোর্টধারী যাত্রী ফেরত আসার কথা ছিল তার চেয়ে বেশি যাত্রী ফেরত আসায় জেলার কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রগুলো পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ফেরত আসা যাত্রীদের খুলনা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ ও নড়াইলে পাঠানো হচ্ছে।

উল্লেখ্য, গেল এপ্রিলে বেনাপোল দিয়ে ভারতফেরত বাংলাদেশিদের মধ্যে করোনা শনাক্ত হয় ৩৫ জনের শরীরে। এর মধ্যে দু’দেশের মধ্যে যাতায়াত বন্ধের পর বিশেষ ব্যবস্থায় আসা ব্যক্তি রয়েছেন ৫ জন। এদের সবাইকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালের রেড জোনে। তবে নিরাপত্তা দুর্বলতার কারণে ২৫ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ১০ জন করোনা রোগী পালানোর মতো ঘটনা ঘটে। রোগী পালানোর ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। 

এসপি