সন্তানকে নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন আমেনা
পরিবারে সঙ্গে সন্তানসহ আমেনা
এমনিতেই দরিদ্র পরিবারে জন্ম আমেনার। এক দুর্ঘটনায় হারান বাবাকে। এতে সংসারে নেমে আসে অন্ধকার। কূল-কিনারা না পেয়ে নেমে পড়েন কাজে। কর্মস্থলে পরিচয় হয় একজনের সঙ্গে। বিয়ে করেন তাকে। এখানেও সুখ সয়নি বেশি দিন। একদিন স্বামীও চলে যান তাকে রেখে। এবার কষ্ট হয় দ্বিগুণ। কোলজুড়ে আসে সন্তান। বাবার পরিবারে কষ্টেসৃষ্টে পড়ে থাকা আমেনা এখন স্বামীর বাড়ির ন্যায্য হিস্যা পেতে চান। এজন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি।
আমেনা বেগম (৩২) স্বামী মারা যাওয়ার ছয় দিন পরে চলে আসেন বাবার বাড়ি মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার উথুলী ইউনিয়নের ছোট বাহ্মণকুল গ্রামে। তার বাবা আবুল কাশেম এক দুর্ঘটনায় মারা যান। বর্তমানে পরিবারে আছেন মা অজিরন বেগম ও এক প্রতিবন্ধী বোন। টিন আর পাটখড়ি দিয়ে বানানো ভাঙাচোরা ঝুপড়ি ঘরেই তাদের বসবাস।
আমেনা যখন বাবার বাড়িতে আসেন, তখন তিনি ছিলেন ছয় মাসের সন্তানসম্ভবা। বর্তমানে তার কোলে তিন মাসের শিশুসন্তান আবদুল মোহাম্মদ শেখ। কিন্তু অভাবের সংসারে আয়রোজগার না থাকায় পুষ্টিকর খাবার খেতে পান না, সন্তানও পাচ্ছে না বুকের দুধ। তাই প্রতিবেশীদের কাছে ভাতের মাড় (ফেন) চেয়ে এনে সন্তানকে খাওয়াতে হয় তাকে।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ছয় বোন আর দুই ভাইকে নিয়ে আমেনার পরিবার। বোনদের মধ্যে তিনি পঞ্চম। পরিবারে অভাবের কারণে দশম শ্রেণি থেকেই লেখাপড়ার ইতি টানতে হয় আমেনার। ২০০৯ সালে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা আবুল কাশেম মারা যান। পরিবারে নেমে আসে অভাব। সে কারণে বেরিয়ে পড়েন জীবিকার সন্ধানে।
পরে সাভারের আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় কাজ পান তিনি। সেখানে চাকরি করেন আট বছর। এরপর ২০১৮ সালে ঢাকার আশুলিয়ার ডেন্ডাবর শারিনটেক গ্রামের মৃত আবদুর রহমান মোল্লার ছেলে আবদুল মজিদের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে তিনি আমেনাকে বিয়ে করেন।
বিজ্ঞাপন
বিয়ের দেড় বছর পর আমেনা সন্তানসম্ভবা হন। তবে ছয় মাসের গর্ভাবস্থায় স্বামী আবদুল মজিদ মোল্লা মারা গেলে স্বামীর বাড়িতে আর জায়গা হয় না আমেনার। এ অবস্থায় চলে আসেন বাবার বাড়িতে। এরপর চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি আমেনার কোলজুড়ে জন্ম নেয় ছেলে আবদুল মোহাম্মদ শেখ।
এদিকে স্বামীর সম্পদের অংশ পেতে আমেনা শ্বশুরবাড়ি এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বার এমনকি আশুলিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা পাননি।
আমেনার মা অজিয়া বেগম (৬৫) ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক কষ্টে আছি আমরা। দেখার মতো কেউ নাই। আমার ছেলেদের অর্থের অবস্থাও ভালো না। প্রতিবেশীদের কাছে ধারকর্জ করে আমেনারে নিয়া চলতাছি। থাকার মতো ভালো একটা ঘর নাই, একটা কলও (টিউবওয়েল) নাই। সরকার যদি একটা ঘর, একটা কল দিত...
এ বিষয়ে আমেনা ঢাকা পোস্টকে বলেন, খাবার ছাড়া অনেক দিন কাটাইছি। একটি চাপড়ি খেয়েও দিন পার করছি। অভাবের কারণে তিন মাসের শিশুসন্তানের দুধ কিনতে পারিনি। দেড় মাস বয়সের সময় হঠাৎ ডায়রিয়া, জ্বর, ঠান্ডায় আমার বাচ্চাটি মারা যাওয়া উপক্রম হইছিল। কিছুই খাচ্ছিল না, বুকের দুধও খায় না, খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। পরে আমার এক ভাইয়ের সহযোগিতায় চিকিৎসা করাই। আল্লাহ আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, সন্তানকে মানুষ করতে মৃত স্বামীর সম্পত্তির হিস্যা পেতে সবার কাছে ধরনা দিয়েছি। কোনো কিছুই হলো না। আমি সরকারের সহযোগিতা কামনা করি। এই অসহায় শিশুর ভবিষ্যতের কথা ভেবে সরকার আমার সম্পত্তি পেতে সহায়তা করুক।
আমেনার প্রতিবেশী পল্লিচিকিৎসক রহিজ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমেনা খাতুন খুব অসহায়। তার আয়ের কোনো উৎস নেই। তার পাশে দাঁড়ানোর মতো অভিভাবক বা ব্যবসার জন্য পুঁজি দেওয়ার মতো কেউ নেই। এ অবস্থায় কোনো সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিও থেকে যদি সহযোগিতা পান, তাহলে তিনি শিশু সন্তান নিয়ে ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে পারবেন।
এ বিষয়ে শিবালয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বি এম রুহুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক সহায়তার তালিকায় আমেনার নাম সংযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া স্থায়ীভাবে কিছু করে দেওয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করছি ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে সেটি হয়ে যাবে।
ইউএনও বলেন, আমরা আপনাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি আমেনার স্বামীর বাড়িতে কিছু অর্থসম্পত্তি রয়েছে। আমরা সাভার উপজেলার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব। তিনি যেখানে চাকরি করতেন, সেখানে যোগাযোগ করে তার প্রাপ্য হিস্যা পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে বলে জানান ইউএনও।
উল্লেখ্য, গত ২৮ এপ্রিল বাচ্চার দুধ কেনার টাকা না থাকায় ৩৩৩ নম্বরে কল করেন আমেনা। পরে বিষয়টি অবগত হয়ে শিবালয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম রুহুল আমিন ওই দিন রাতে আমেনার বাড়িতে গিয়ে শিশুখাদ্য নিয়ে হাজির হন। ৩০ এপ্রিল ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আমেনার বাচ্চার দুধসহ এক মাসের খাদ্যসহায়তা করেন ঢাকার আবাহনী ক্লাবের পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড় মো. সোহেল রানা।
সোহেল হোসেন/এনএ/জেএস