বিপদে পড়লেই মানিকের কাছে ছুটে আসে অসহায় মানুষ
টাকা থাকলেই মানবসেবা করা যায় না; প্রয়োজন মানসিকতার। তার দৃষ্টান্ত দেখালেন যশোরের তোফাজ্জেল হোসেন মানিক। আর্থিক দৈন্যতায় থেকেও দরিদ্র মানুষের কল্যাণে কাজ করছেন। এজন্য বিপদে পড়লেই মানিকের কাছে ছুটে আসে অসহায় মানুষ।
শিক্ষাবৃত্তি, বিনা সুদে ঋণ সুবিধা, মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনামূল্যে কারিগরি প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি। বেকারত্ব কমাতে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরির স্বপ্ন দেখছেন। এ পর্যন্ত তিন শতাধিক ব্যক্তিকে বিনা সুদে ঋণ ও চার শতাধিক শিক্ষার্থীকে বৃত্তিসহ নানা উপকরণ দিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
যশোরের রেলগেট এলাকার মৃত আব্দুল জব্বারের ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে মানিক চতুর্থ। আর্থিক অনটনের কারণে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। পরবর্তীতে নিজ উদ্যোগে বই পড়ে শিখেছেন অনেক কিছু। ১২ বছর বয়স থেকে শুরু করেন হকারির ব্যবসা।
কখনো আইসক্রিম, কখনো বাদাম আবার কখনো শোনপাপড়ি বিক্রি করেছেন। এরপর শুরু করেন ভাঙারির ব্যবসা। সেখান থেকে হয়ে উঠেন উদ্যোক্তা। শুরু করেন বিভিন্ন গাড়ির ব্রেক-সু তৈরির কাজ। এখন পরিবারের সবাই এ ব্যবসা করছেন। গড়েছেন বিক্রয়কেন্দ্র।
বিজ্ঞাপন
২০০৩ সাল থেকে সামাজিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। সমাজের অবহেলিত মানুষকে বিনা সুদে ঋণ দেন। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তাসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। গড়ে তোলেন ‘গড়ব সমাজ কল্যাণ সংস্থ্যা’ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
তোফাজ্জেল হোসেন মানিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া করতে পারিনি। আমার প্রচল ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া করব। তাই বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জ্ঞানীগুণী মানুষের বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে থাকি। অভাবের কারণে ১২ বছর বয়সে পরিশ্রম শুরু করি। কখনো ফেরিওয়ালা, কখনো আইসক্রিম বিক্রি করেছি। সেই থেকে স্বপ্ন দেখতাম, একটু প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে অসহায় মানুষের জন্য কিছু করব।
তিনি বলেন, ২০০৩ সাল থেকে এসব কার্যক্রম শুরু করলেও ২০১১ সালে সাংগঠনিকভাবে রূপ দিলাম। যখন যশোরের কয়েকজন গুণী মানুষ আমার কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে অর্থ সহায়তা দেওয়া শুরু করেন তখন কাজের মান ও পরিধি বেড়ে যায়।
মানিকের এমন কর্মকাণ্ডে খুশি স্ত্রী বিউটি বেগম। তিনি বলেন, প্রথমে তার সমাজকর্ম ভালো লাগত না। এসব নিয়ে কথা বললে পরিবারের অশান্তি দেখা দিত। পরে ভাবলাম সমাজের ভালোর জন্যই তো কাজ করছে। তবে এখন তার কাজে অনেক খুশি।
মানিকের সামাজিক কর্মকাণ্ড দেখে অনুপ্রাণিত তার স্কুলপড়ুয়া ছেলে সিয়াম। তার ভাষ্য, বাবার কাজ খুব ভালো লাগে। বাবা সবসময় একটা কথা বলেন ‘ভালো মানুষ হওয়ার পাশাপাশি দক্ষ মানবসম্পদ’ হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। আমাকে সব কাজ হাতেকলমে শিখিয়ে দেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তার কাছে হাতের কাজগুলো শিখি। সামাজিক কাজগুলোতে তাকে সহযোগিতা করি।
মানিকের সহযোগিতা পেয়েছে অনেক মানুষ। পাশাপাশি বিনা সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে সফলতা পেয়েছে। বন্ধ হতে বসা শিক্ষার্থীদেরও লেখাপড়া চলছে।
যশোর শহরের মিউনিসিপ্যাল স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী তামিম ইকবাল বলেন, আমার বাবা নেই। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। পড়াশোনা করার ইচ্ছা থাকলেও অর্থের অভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তখন মানিক আঙ্কেলের ‘গড়ব সমাজ কল্যাণ সংস্থ্যা’ আমার পড়াশোনার দায়িত্ব নেয়। তিনি যদি দায়িত্ব না নিতেন তাহলে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেত।
যশোর রেলগেট এলাকার কলা ব্যবসায়ী মুরশিদা বেগম বলেন, গড়ব সমাজ কল্যাণ সংস্থ্যা থেকে বিনা সুদে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে কলার ব্যবসা শুরু করি। ব্যবসা আরও বড় করেছি। পরে কয়েক ধাপে বিনা সুদে টাকা নিয়ে শোধ করেছি।
জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি বাংলাদেশ (নাসিব) যশোরের সভাপতি সাকির আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, তোফাজ্জেল হোসেন মানিক যশোরের উদ্যোক্তা। পাশাপাশি যশোরের বিভিন্ন সামাজিক কাজে তার অংশগ্রহণ রয়েছে। বেকারত্ব কমাতে দীর্ঘদিন ধরে তরুণ ও নারীদের হাতেকলমে বিভিন্ন শিক্ষা দিয়ে আসছেন। বিষয়টি ইতিবাচক। এ কাজকে গতিশীল রাখতে সহযোগিতা করব। পাশাপাশি এ কাজে সমাজের বিত্তবানদের অংশগ্রহণের অনুরোধ জানাই।
এএম