বাড্ডায় সাড়ে ১৬ শতাংশ জমির স্বপ্নকুটিরের নিমাণাধীন ১১তলা ভবন ও মামলার আসামি তিন ভাই

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একই পরিবারের চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আদালতে মামলা করেছেন তারিকুজ্জামান তুহিন নামের এক ব্যবসায়ী।

১২ ডিসেম্বর রংপুর স্পেশাল জজ আদালতে মামলা করেন তারিকুজ্জামান তুহিন। মামলাটি দুদককে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন আদালত; একই সঙ্গে আগামী ২৮ জানুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছেন।

মামলার বাদী তারিকুজ্জামান তুহিন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দরের আমদানি ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স তুহিন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী।

আসামিরা হলেন রংপুরের মাহিগঞ্জ পূর্বখাসবাগ এলাকার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য নুর ইসলাম ও তার ছেলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) উপপরিদর্শক (এসআই) মনিরুজ্জামান সুমন, শিল্পাঞ্চলের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রোকনুজ্জামান, কুড়িগ্রাম আদালত পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মফিকুজ্জামান, হাসানুজ্জামান ও পুত্রবধূ কাজলি বেগম।

মামলার বিবরণে জানা যায়, এপিবিএনের এসআই পরিচয় দিয়ে মনিরুজ্জামান বুড়িমারী স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী তারিকুজ্জামান তুহিনের কাছ থেকে ১৮ লাখ ৯২ হাজার ৪৫৫ টাকার পাথর কেনেন। টাকা চাওয়ায় মুঠোফোনে হুমকি দেন এবং স্ত্রী ও বোনকে দিয়ে একাধিক মিথ্যা নারী নির্যাতন মামলা দেন মনিরুজ্জামান। যা আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এভাবে পুলিশি ক্ষমতা ব্যবহার করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০১৩ সালে পুলিশ থেকে অবসর নেয়া নুর ইসলাম রংপুর সাতমাতা পূর্বখাসবাগে ১২ শতাংশ জমির ওপর ১০তলা বাড়ি নির্মাণ করেন। তার ছেলে এসআই মনিরুজ্জামান ২০১৪ সালে পুলিশে যোগ দিয়ে ছয় বছরে ঢাকার বাড্ডায় সাড়ে ১৬ শতাংশ জমির স্বপ্নকুটিরের ১১তলা ফ্ল্যাটের ৪০ লাখ টাকার শেয়ারের মালিক হন।

রাজধানীর সবুজবাগে এসআই মনিরুজ্জামান ও তার স্ত্রী কাজলির নামে ৯৬ লাখ টাকার ৮ শতাংশ জমির ওপর ১০তলার গ্রিনপ্লাজা নির্মাণাধীন। এসআই মনিরুজ্জামান এবং তার ভাই এএসআই রোকনুজ্জান, হাসানুজ্জামান ও দুজন পার্টনারের নামে ঢাকার দক্ষিণ কাজি বাড়ি মোড়ে ৫ কাঠা জমির ওপর ড্রিমওয়ে টাওয়ার নামে ১০তলা ভবন নির্মাণাধীন। আফতাবনগরে দেড় কোটি টাকার ৫ কাঠা জমির গ্রিন সুরভী কনস্ট্রাকশনের ব্যবসার অর্ধেক শেয়ারের মালিক মনিরুজ্জামান। তিন বছরের ছেলে আল ওয়াফির নাম অনুসারে ‘আল ওয়াফি প্রোপার্টিজ’ রিয়েল এস্টেট গড়েছেন তিনি।

রংপুরের কামালকাছনায় ১৪ শতাংশ জমি কিনেছেন এএসআই মফিকুজ্জামান

ঢাকার খিলগাঁও ত্রিমোহনী এলাকায় আড়াই কাঠা, বনশ্রীর লিংক রোডে ৩ কাঠা জমি এবং আফতাবনগরের মেরুল বাড্ডায় ১২ কাঠা জমির ওপর ১৪তলা ড্রিম ভ্যালির ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন এসআই মনিরুজ্জামান।

এছাড়া বনশ্রী টেকেরপাড় চৌরাস্তা মোড়ে ৩ কাঠায় ৭তলা, একই এলাকার জে ব্লকে ১০ কাঠা, পাশে ৩ কাঠা ও আফতাবনগর আবাসিক এলাকার সাড়ে ৫ কাঠা, বসুন্ধরা এল ব্লকে ৫ কাঠা জমিতে নির্মাণাধীন ফ্ল্যাটের শেয়ার বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন তিনি। বনশ্রী ব্লক জে-তে গ্রিন প্লাজা ও আফতাবনগরের এল ব্লকে ড্রিমটাচ টাওয়ার নামে বহুতল ভবন নির্মাণ শুরু করেছেন মনিরুজ্জামান। ২০১৬ সালে রংপুরের পীরগাছার কাজলি বেগমকে বিয়ে করে অবৈধ সম্পদ বৈধ করতে স্ত্রীর নামে হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন তিনি।

এদিকে এএসআই রোকনুজ্জামান ২০০৭ সালে পুলিশে যোগ দিয়ে ২০১৭ সালে পদোন্নতি নিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হন। তিনি ঢাকার জিয়া সরণি রোডে ৯০ লাখ টাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনে ভাড়া দিয়েছেন। 

বাড্ডায় কফি এক্সপ্রেস নামের ৪৫ লাখ টাকার দোকানটি এএসআই রোকনুজ্জামানের নামে। একই সঙ্গে ঢাকার দক্ষিণ বনশ্রী ফাউন্ডেশন ড্রিম ক্যাসটেল প্রজেক্টের এল ব্লকে ৮৬ লাখ টাকায় ডাবল ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। তার নামে রয়েছে দুটি পাসপোর্ট। প্রায়ই বিভিন্ন দেশে ব্যক্তিগত কাজে ভ্রমণ করেন রোকনুজ্জামান।

অপরদিকে এএসআই মফিকুজ্জামান ভাইদের পুলিশি ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে ৭৪ লাখ টাকায় রংপুরের কামালকাছনায় ১৪ শতাংশ জমি কিনেছেন। অপর ভাই হাসানুজ্জামান চট্টগ্রামে জাহাজে চাকরি করলেও নিজেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে ভাইদের প্রভাবে মাদক ব্যবসায় জড়িত পড়েছেন।

এই পুলিশ পরিবার স্বজনদের নামে ইটভাটা, চালের আড়ৎ ও মুদি দোকান দিয়েছে। পুলিশে চাকরির প্রভাব খাটিয়ে অবৈধপথে অর্থ আদায় করে ২০১৪ সালে হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয় পরিবারটি। তাদের অবৈধ সম্পদের তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নিতে ছয়জনের বিরুদ্ধে রংপুর স্পেশাল জজ আদালতে মামলা করেন তারিকুজ্জামান।

এ বিষয়ে এসআই মনিরুজ্জামান বলেন, আমার স্ত্রী তার বান্ধবীর সঙ্গে যৌথ ব্যবসা করে সম্পদ বানিয়েছেন। স্ত্রীর ব্যবসায় তো বাধা নেই। আমার মাত্র একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। পুলিশের অনেকে অনেক কিছু করেছেন। পাথরের কিছু টাকা বকেয়া থাকায় ব্যবসায়ী তুহিন মামলা করেছেন। আইনিভাবে মামলা মোকাবিলা করব।

কুড়িগ্রাম আদালত পুলিশের এএসআই মফিকুজ্জামান বলেন, ওই ব্যবসায়ীর দ্বন্দ্ব ভাইয়ের সঙ্গে। সেই বিরোধে আমার বিরুদ্ধে মামলা করে হেয় করার কারণ বুঝলাম না। আমি ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করব। আমার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। 

রংপুর জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট অর্পিতা বসু রায় বলেন, আসামিরা পুলিশি ক্ষমতা দেখিয়ে অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। তাই দুদক ও মানি লন্ডারিং আইনে বাদীর দায়ের করা মামলা আমলে নিয়ে দুদককে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।

এএম