ডাক্তার যত দূরেই থাকুক না কেন নির্দেশনা মেনে রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করবে রোবট। এবার এমনই একটি রোবট উদ্ভাবন করেছেন বরিশাল অমৃত লাল দে কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র শুভ কর্মকার। তার রোবট শুধু চিকিৎসাসেবায় অবদান রাখবে না, পাশাপাশি রোগীর অক্সিজেন সেচুরেশন কমে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎপাদন করে ১৫ থেকে ২০ মিনিট অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারবে। 

একই সঙ্গে ওষুধ আনা-নেওয়া, অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দেওয়া, রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধ সরবরাহ করা, সংক্রমিত রোগীর বর্জ্য তার শরীরে থাকা ইউভি রশ্মির মাধ্যমে জীবানুমুক্ত করতে পারবে। নতুন উদ্ভাবিত এই রোবটের নাম ‘সেবক’। চিকিৎসাসেবায় কাজ করবে বলে এর নাম সেবক রাখা হয়েছে বলে জানান শুভ কর্মকার। চিকিৎসাক্ষেত্রে সরাসরি সহযোগিতার জন্যই তার এই প্রচেষ্টা।

‘সেবক’ শুভ কর্মকারের দ্বিতীয় উদ্ভাবন। এর আগে ২০১৮ সালে জগদ্বিখ্যাত রোবট সোফিয়া যখন বাংলাদেশ ভ্রমণে আসে তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে শুভ কর্মকার উদ্ভাবন করেন রোবট ‘রবিন’। ২০১৭ সালের অক্টোবরে সৌদি আরবে নাগরিকত্ব পাওয়া রোবট সোফিয়া শুধুমাত্র ইংরেজিতে কথা বলতে পারলেও ওই সময়ের দশম শ্রেণির ছাত্র শুভ কর্মকারের উদ্ভাবিত ‘রবিন’ বাংলায় কথা বলতে পারতো; প্রশ্নোত্তরে অংশ নিতে পারতো। ফলে ‘রবিন’ দৃষ্টি আকর্ষণ করে পুরো দেশবাসীর।

শুভ কর্মকার বলেন, রবিন মানবাকৃতির রোবট। কোথাও আগুন লাগলে বা গ্যাস লিকেজ হলে সংকেত পাঠাতে পারতো। কিন্তু দেশসহ সারাবিশ্ব একটি সংক্রমণের সঙ্গে লড়াই করছে। এ ক্ষেত্রে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি- এমন প্রশ্ন থেকেই দ্বিতীয় রোবট ‘সেবক’ প্রকল্পে হাত দেই। তিন মাসের প্রচেষ্টায় একটি মডেল বাস্তবায়ন করেছি।

তিনি আরও বলেন, মডেল বলতে আমি বোঝাতে চাই- এমনভাবে একটি রোবট তৈরি করা হলে সে প্রকৃতপক্ষেই ডাক্তার এবং রোগীর মধ্যে যোগাযোগের একটি মাধ্যম হয়ে কাজ করতে পারবে। ‘সেবক’ সরাসরি রোগীর কাছে যেতে পারবে। তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে সঙ্গহীন রোগীকে সঙ্গ দিতে পারবে। ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডাক্তার বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক রোগীর সর্বশেষ অবস্থা সরাসরি দেখতে পারবেন, রোগীর সঙ্গে কথা বলতে পারবেন এবং প্রেসক্রিপশন দিতে পারবেন। 

রোবট রবিন ও সেবকের সঙ্গে শুভ কর্মকার

শুভ কর্মকার বলেন, বর্তমান প্রযুক্তির যুগে ভিডিও কলে ডাক্তার এবং রোগী বলতে পারেন। কিন্তু করোনায় সংক্রমিত রোগীর কাছে কেউ সহসাই যেতে চান না। এক্ষেত্রে কার্যকরি ভূমিকা রাখবে সেবক। কারণ কোনো রোগীর অক্সিজেন সংকট দেখা দিলে তার কাছে সংরক্ষিত পানি ভেঙে রোগীকে অক্সিজেন সরবারহ করতে পারবে। এছাড়াও রোগীর বর্জ্য রোবট সেবকের শরীরে থাকা ডাস্টবিনে ফেলা হলে ইউভি রশ্মির মাধ্যমে তা জীবানুমুক্ত করে ফেলবে। সেক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি নেই। রোবট ‘সেবক’ বৃহৎ পরিসরে বাস্তবায়ন করা হলে করোনা মোকাবেলা সহজ হবে। রোগী তার প্রয়োজনীয় সেবা পাবে আবার চিকিৎসকও নিরাপদ দূরত্বে থেকে চিকিৎসা দিতে পারবেন।

বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের কালুপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শুভ কর্মকার। তার বাবা সন্তোষ কর্মকার। দুই ভাইবোনের মধ্যে বড় শুভ। তিনি গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হয়েছেন বরিশাল বিভাগীয় শহরের অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ে। কিন্তু তার আফসোস, ভর্তির পর একদিনও শ্রেণি কক্ষে যেতে পারেননি। মহামারি করোনা সংক্রমণ রোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় তার এই প্রতিবন্ধকতা। সেই সুবাদে নিজের রোবট নিয়ে কাজ করার বিস্তর সুযোগ হয়েছে।

শুভ কর্মকার বলেন, ভবিষ্যতে আমি শুধু রোবট নিয়েই কাজ করতে চাই। রোবটিক্স আমার প্রিয় বিষয়। রোবট উদ্ভাবন করে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে চাই। 

তিনি আরও বলেন, আমার প্রথম উদ্ভাবিত রোবট রবিনের প্রযুক্তি আরও আধুনিক ও উন্নত করতে কাজ করছি। কারন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রাক্কালে বিশ্বের অনেক দেশ রোবটিক্স ওয়ার্কে অনেক এগিয়ে গেছে। রোবট হয়ে উঠেছে উত্তম বন্ধু। কিন্তু বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। আমি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে বাংলাদেশ যেন রোবট বা কম্পিউটার প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকতে পারে সেজন্য কাজ করছি। আমি মানব কল্যাণে রোবট উদ্ভাবন করতে চাই।

২০১৮ সালের ১৫ মে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের উদ্ভাবন বিষয়ক জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় হয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করে রবিনের উদ্ভাবক শুভ কর্মকার। ২০১৯ সালের ২৭ জুন ৪০তম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের হাত থেকে পুরস্কার নেয়। এছাড়াও সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ-২০১৯ এ বিজ্ঞান বিষয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে ১ম হয়ে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিয়ে ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির হাত থেকে ‘বছরের সেরা মেধাবী’ পুরস্কার নেয় শুভ কর্মকার। তারই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় রোবট উদ্ভাবন করলেন এই ক্ষুদে বিজ্ঞানী।

উল্লেখ্য, আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আরো দুজন ছাত্র দুটি রোবট উদ্ভাবন করেছেন। এর মধ্যে পালপাড়ার সুজন পালের উদ্ভাবিত ‘বঙ্গ’ ও ভদ্র পাড়ার শাওন সরদার সোলাইমান উদ্ভাবন করেন ‘মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট’।

গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জহিরুল হক জানান, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র শুভ কর্মকার ২০১৮ সালে প্রথম উদ্ভাবন করে বাংলা ও ইংরেজিতে কথা বলা রোবট রবিন। ওই একই শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সুজন পাল চলতি বছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের মাসে উদ্ভাবন করে বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দিতে কথা বলতে পারা রোবট। এছাড়া শাওনও এ বছর একটি রোবট তৈরি করেছে। এখন শুনলাম শুভ কর্মকার আরও একটি রোবট তৈরি করেছে। 

তিনি বলেন, আমরা ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করি। যে কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিভা বিকশিত করতে পারছে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখছে। ওদের উদ্ভাবন ও এগিয়ে যাওয়ায় আমরা গর্বিত।

আরএআর