মা, স্ত্রী, চার কন্যাসন্তান নিয়ে বড় একটি সংসারের দায়িত্ব এখন ফারুকের কাঁধে

একসময়ের তুখোড় ও রাজপথ কাঁপানো ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন আনোয়ার হোসেন ফারুক। ছাত্রলীগের দুঃসময়ের সঙ্গী ফারুক ছিলেন কবিরহাট সরকারি ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। দক্ষতা আর প্রজ্ঞা দিয়ে দলকে রেখেছিলেন সুসংগঠিত। দলের জন্য জেল-জুলুমের শিকারও হয়েছেন। লেখাপড়াটাও শেষ করতে পরেননি। কিন্তু নির্লোভ এই ছাত্রনেতা আজ পাদপ্রদীপের আড়ালে। কারণ, ফারুক এখন জীবন বাঁচাতে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন রিকশা চালানোকে।

স্থানীয় ও ফারুকের একসময়ের সকহর্মী রাজনীতিবিদরা মনে করেন, যারা নিজেদের মনের কথা কাউকে বলেননি, যারা সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেছেন, দীর্ঘ সময় দল ক্ষমতায় থাকার পরও তাদের রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে রিকশা চালাতে হয়, তাহলে এটা তাদের জন্য লজ্জার।

আনোয়ার হোসেন ফারুক কবিরহাট উপজেলার পদুয়া গ্রামের মোহাম্মদ উল্যার ছেলে। মোহাম্মদ উল্যার চার ছেলে, দুই মেয়ের মধ্যে ফারুক দ্বিতীয়। মা, স্ত্রী, চার কন্যাসন্তান নিয়ে বড় একটি সংসারের দায়িত্ব এখন ফারুকের কাঁধে।

জানা যায়, ২০০১ সালে বিএনপি জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রম যখন নিভু নিভু অবস্থায়, তখন দাপটের সঙ্গে কবিরহাট সরকারি ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে সংগঠন গুছিয়ে তোলেন তিনি। সাংগঠনিক কার্যক্রমে সক্রিয় থাকায় জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ফারুক।

কথা হয় আনোয়ার হোসেন ফারুকের সঙ্গে। একসময়ের উজ্জ্বল স্মৃতিচারণা করে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ১৯৯৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই। ওই বছরই কবিরহাট পদুয়া শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। ২০০১ সালে কবিরহাট উচ্চবিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি, ২০০৩ সালে বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে কবিরহাট সরকারি ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই।

তিনি বলেন, তখনকার সময়ে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতে গিয়ে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের রোষানলে পড়তে হয়। যার কারণে ডিগ্রি পরীক্ষাটা পর্যন্ত দিতে পারিনি। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর একটি ছোটখাটো চাকরির জন্য নেতাদের দরজায় দরজায় ঘুরেছি, কিন্তু পাইনি। তারপরও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি থেকে সরে যাইনি।

কত দিন ধরে রিকশা চালাচ্ছেন এবং কেন, জানতে চাইলে বলেন, এক বছর ধরে রিকশা চালাচ্ছি। স্থানীয়ভাবে পরিচিত হওয়ায় অনেকেই আমার রিকশায় উঠতে চান না। টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ওয়ার্ড থেকে শুরু করে দলের উচ্চপর্যায়ে অনেকেই নানা উপায়ে অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। কিন্তু আমরা যারা শ্রম-ঘাম দিয়ে আজকের আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছি, তাদের মূল্যায়ন হয়নি।

‘অনুপ্রবেশকারীদের ভিড়ে আমরা হারিয়ে গেছি’ জানিয়ে বলেন, আমরা অপরাজনীতির শিকার হয়েছি। রাজনীতি করতে গিয়ে কোনো কাজও শিখিনি, যে কারণে আজ অর্থাভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে অসহায় অবস্থায় জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

স্থানীয়রা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন ফারুক। রাজনীতি করে তিনি নিজের জন্য কিছুই করতে পারেননি। এত দিন দল ক্ষমতায় থাকার পরও তিন বেলা ভাত জোগাড় করা এখন তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফারুকের সঙ্গে রাজনীতি করা ডা. শফিকুল ইসলাম স্বপন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফারুক একসময় রাজপথ কাঁপিয়েছেন। তার সঙ্গে রাজনীতি করেছি। বর্তমানে ফারুক রিকশা চালাচ্ছেন, এটা আমাদের জন্য পীড়াদায়ক। আমি ফারুকের রিকশায় উঠি না লজ্জায়। তবে দেখা হলে খোঁজখবর নেই।

কবিরহাট উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আবু জাফর আবির বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ফারুকের মতো কর্মীরা অবহেলিত, এটি দুঃখজনক। জীবিকার জন্য ফারুক রিকশা চালাচ্ছেন। এতে লজ্জার কিছু নেই। তবে অনেকেই এটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করছেন। আমরা যুবলীগ বিষয়টি নিয়ে দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলব। দেখি তার জন্য কিছু করতে পারি কি না।

কবিরহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য আলাবক্স তাহের টিটু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছাত্ররাজনীতি করে দুঃসময়ে দলের পাশে ছিলেন ফারুক। দলকে সুসংগঠিত করে রেখেছেন তিনি। দলের জন্য জেল-জুলুমের শিকার ও হয়েছেন আজ এমন ছাত্রনেতা রিকশা চালাচ্ছেন, এটা আমাদের সবার জন্য লজ্জার।

তিনি বলেন, কবিরবাটের প্রতিটি ইউনিয়নে অনেক ফারুক আছেন, যারা নিজেদের মনের কথা কাউকে বলতে পারেন না। তারা মুখ বুজে সহ্য করে আছেন। তাকিয়ে আছেন যাদের পেছনে থেকে রাজনীতি করেছেন, তাদের দিকে। দীর্ঘ সময় দল ক্ষমতায় থাকার পরও ফারুকদের জন্য রাজনীতি ছেড়ে রিকশা চালাতে হয়, তাহলে আমাদের আর কিছুই বলার নেই।

এই এলাকার সংসদ সদস্য সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চাইলে ফারুকের পাশে দাঁড়াতে পারেন। এ ছাড়া দলীয় হাইকমান্ড থেকে এই ত্যাগী নেতা-কর্মীদের খুঁজে বের করে তাদের মূল্যায়ন করা উচিত বলে মনে করেন এই নেতা। 

হাসিব আল আমিন/এনএ