সামগ্রিক উন্নয়নের বাজেট চাই
প্রফেসর ড. লুৎফুল হাসান, আমিনুল হক শামীম ও তানিয়া সুলতানা
করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবা গ্রাস করেছে অর্থনীতির প্রতিটি ধাপ। গত অর্থবছরে এর বিরূপ প্রভাব না পড়লেও মহামারির বিরূপ প্রভাব এখন অর্থনীতির সবক্ষেত্রেই। তাই ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট অর্থনীতি পুনরুদ্ধার তথা সামগ্রিক উন্নয়নের হতে হবে বলে মনে করছেন ময়মনসিংহের ব্যবসায়ী নেতারা। যদিও অনেকটাই ব্যতিক্রম ই-কমার্স খাত। লকডাউনে এ খাতটি সর্বোচ্চ বিকশিত হয়েছে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসছে বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্বতন্ত্র নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
অন্যদিকে অতিমারির সময়ে শিক্ষা এবং গবেষণার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদরা। বলছেন, বৈশ্বিক এই সংকটে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণা সংকটের বিষয়টি তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে। তাই বিশেষ বিবেচনায় এবারের বাজেটে গবেষণা খাতে জোর দিতে হবে।
বিজ্ঞাপন
আসছে বাজেট কেমন হওয়া চাই এ নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. লুৎফুল হাসান, এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভপাতি আমিনুল হক শামীম ও উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের (উই) ময়মনসিংহ জেলা প্রতিনিধি তানিয়া সুলতানা।
জোর দিতে হবে গবেষণা খাতে : প্রফেসর ড. লুৎফুল হাসান
বিজ্ঞাপন
কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণা সংকটের বিষয়টি তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে। তাই বিশেষ বিবেচনায় এবারের বাজেটে গবেষণা খাতে জোর দিতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) উপাচার্য প্রফেসর ড. লুৎফুল হাসান। তিনি বলেন, বিজ্ঞানসম্মত লেখাপড়া ও বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই এমন দুর্যোগ মোকাবিলার কোনো বিকল্প নেই। এখন তা আর স্পষ্ট।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক দিক তুলে ধরে এই শিক্ষাবিদ বলেন, বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্তরের যে শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে এই ব্যবস্থাকে আরও বেগবান করা ও শাণিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। বর্তমান সরকার এ নিয়ে যদিও চেষ্টা করছে, তবে বাজেটে এর প্রতিফলন জরুরি।
তিনি বলেন, দেখা যাচ্ছে বর্তমানে কোভিডের কারণে এবং কোভিড পরবর্তী অবস্থায় শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। বাল্যবিয়েও বেড়ে যেতে পারে। এ জন্য কোনো অবস্থাতেই যেন ঝড়ে পড়ার হার না বাড়ে সেজন্য নিচের দিকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। বিশেষ করে মিডডে মিলটা যদি পুরোদমে চালু হয়, তখন বড় আকারের একটি পরিবর্তন আসবে, প্রধানমন্ত্রী যেটা চেয়েছেন।
সকল সুযোগ সুবিধা কৃষকদের জন্য বাড়াতে হবে এমনটি জানিয়ে উপাচার্য লুৎফুল হাসান বলেন, কৃষকদের যে কর দিতে হয়, এই পরিমাণটা আরও মওকুফ করা দরকার। যে বাজেট হবে সেখানে কৃষকরা যাতে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারে, তাদের সন্তানরা যাতে আরও ভালো করতে পারে সেই বিষয়টি চিন্তা করতে হবে। বাজেটে কৃষকের যেন করের বোঝা বইতে না হয়। যেহেতু এই সরকার কৃষিবান্ধব তাই কৃষকের পাশেই থাকতে হবে।
তিনি মনে করেন, বাজেটে নতুন নতুন প্রযুক্তি কৃষকের কাছে পৌঁছানোর জন্য বড় আকারে প্রচেষ্টা রাখতে হবে। এতে কৃষকরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দেশের মানুষের খাদ্য এবং পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
নিরাপদ খাদ্যের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, নিরাপদ খাদ্যের কিন্তু কোনো বিকল্প নেই। আমরা যতটুকু খাচ্ছি ততটুকুও যদি নিরাপদ খাদ্য হয় তাহলেই আমরা অনেক এগিয়ে যেতে পারব। খাবার একটু কম হলে সমস্যা নেই। যেমন একটি আম যদি নিরাপদ হয়, তাহলে দুই টুকরো আম খেলেও তাতে লাভ রয়েছে। সুতরাং এখানেও বাজেটের একটা চিন্তাভাবনা সরকারের করা উচিত।
ভিসি বলেন, প্রতি বছরই অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে বিভিন্ন সবজি বিক্রি করতে পারেন না কৃষক। ফলে সেগুলো পচে নষ্ট হয়। তাই খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করার উদ্যোগ রাখতে হবে। এ জন্য বাজারজাতকরণের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রয়োজনে প্রণোদনাও রাখা যায়। কারণ কৃষিতে প্রণোদনা কখনো বিফলে যায় না, শতভাগ কার্যকর হয়।
অতিমারিকে সামলানোর চ্যালেঞ্জ থাকতে হবে : আমিনুল হক শামীম
দি ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের সভাপতি ও এফবিসিআইয়ের সহ-সভপাতি আমিনুল হক শামীম মনে করেন, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় ফের তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে পর্যটন ব্যবসা। পর্যটন খাত এখন অনেকটাই কফিনে শুয়ে আছে। তাই পর্যটন খাতের জন্য আলাদা বাজেটের দাবি এই শিল্পপতির।
এ ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ধারা পুনরুদ্ধারে ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে এবং গ্রামীণ অঞ্চলে নতুন বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য সব ধরনের সুবিধা আসন্ন বাজেটে রাখার জন্য অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি অকর্ষণ করেন বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের এই সদস্য।
আমিনুল হক শামীম বলেন, বিদায়ী অর্থবছরে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ৩ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকার বরাদ্দ বাজেটে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ বাজেট বেসামরিক বিমান পরিবহন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে। আর পর্যটন খাতের জন্য মাত্র ৭২৫ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। এমনকি পর্যটন খাতের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হয়নি বিগত বাজেটে।
তিনি জানান, এখন ১১ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটন খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রত্যাশা ছিল ২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু করোনার দাপটে এমন পরিসংখ্যানের বাস্তবায়ন নিয়ে আমরা শঙ্কিত।
আসন্ন বাজেটে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ানো এবং সেইসঙ্গে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য আড়াই শতাংশ কর্পোরেট হার কমানোর দাবি তোলেন আমিনুল হক শামীম। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কর্পোরেট খাতের কর হার বাংলাদেশের চেয়ে কম। ভারতে ২৫-৩০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়াতে ২২ শতাংশ, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামে ২০ শতাংশ করে।
এ ছাড়া অপ্রদর্শিত অর্থ আয়কর প্রদান সাপেক্ষে শিল্পে বিনিয়োগ করার সুবিধা দিলে নতুন বিনিয়োগ, সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি এবং অপ্রদর্শিত অর্থ বিদেশে পাচার রোধ করা সম্ভব হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। ২০২০-২১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রেকর্ড পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয় থেকে ৯২৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা কর প্রদানের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে এই সুবিধা আগামী বাজেটে অব্যাহত রাখলে দেশের টাকা দেশেই বিনিয়োগ হবে বলে মনে করেন ময়মনসিংহ চেম্বারের এই সভাপতি।
আমিনুল হক শামীম বলেন, গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্ট্রিজ অথবা গ্রুপ অব কোম্পানি তৈরির মাধ্যমে ব্যবসা প্রসারিত করার চেষ্টা করে থাকেন শিল্প মালিকরা। কিন্তু ভাল উদ্যোক্তা অনাকাঙ্ক্ষিত লোকসানে পড়লে অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাপ প্রয়োগ করে। এক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত খেলাপি প্রতিষ্ঠানের দায় অন্য প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে পরিশোধ করার নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে বলে এই শিল্পপতি মনে করেন।
করোনকালীন দুর্যোগে স্থায়ী মূলধনের স্বল্পতা সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি আরও বলেন, নতুন মূলধন গঠনে দেশের পুঁজিবাজার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। কারণ পুঁজিবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইতোমধ্যে আস্থার সঞ্চার করেছে। তবে আসন্ন বাজেট অনেকটাই পুঁজিবাজার বান্ধব।
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজন বিশেষ ব্যবস্থা : তানিয়া সুলতানা
আসছে বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্বতন্ত্র নীতিমালা তৈরির প্রয়োজন তুলে ধরে উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের (উই) ময়মনসিংহ জেলা প্রতিনিধি ও বিরাজবৌর স্বত্বাধিকারী তানিয়া সুলতানা বলেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একজন নারী শুধু চাকরির বাজারে নয়, জাতীয় অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। নারীদের অগ্রগতি এখন স্পষ্ট। তবে করোনকালীন অনেক বড় ধাক্কা এসেছে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য।
তিনি বলেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের ভিত্তির ওপর শুরু হওয়া ডিজিটাল বিপ্লব বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে সব কিছুর পরিবর্তন হচ্ছে গাণিতিক হারে, যা আগে কখনো হয়নি। বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে এ পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে। ফলে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনার প্রচলিত পদ্ধতিগুলো। নারীদের জন্যও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে সরকার আসন্ন বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখবে বলে আমি আশা রাখি।
এসপি