ছয় বছর আগেও নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মতো অবস্থা ছিল রতন-রেশমা দম্পতির। সহায়-সম্বল বলতে কিছুই ছিল না। ছিল না মাথা গোঁজার ঠাঁই। রতন অটোরিকশা চালাতেন। রেশমা উত্তরা এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনে (উত্তরা ইপিজেড) চাকরি নেন। মাত্র ছয় বছরে এখন তারা স্বাবলম্বী। বর্তমানে তারা দুজনেই উত্তরা ইপিজেডের সনিক গ্রুপে চাকরি করেন। নিজেদের উপার্জনে বানিয়েছেন পাকা বাড়ি, কিনেছেন মোটরসাইকেল। জমি বন্ধক নিয়ে ধান ছাড়াও বিভিন্ন ফসল আবাদ করছেন। 

উত্তরা ইপিজেডে চাকরি করেই ভাগ্য বদলেছে নীলফামারী সদর উপজেলার সংগলশী ইউনিয়নের কাজী পাড়ার বাসিন্দা রতন ও রেশমা দম্পতির। দুজনের আয়ে এখন গ্রামে তাদের পরিবারটি সচ্ছল ও স্বাবলম্বী।

রতন ও রেশমা  বলেন, আমরা দুজনেই বর্তমানে উত্তরা ইপিজেডে কাজ করছি। আমাদের আগের অবস্থা এখন নেই। আমরা সাবলম্বী  হয়েছি। নিজের আয়ে বাড়ি-গাড়ি করেছি। এখন আমরা চাই আমাদের সন্তান যেন পড়ালেখা শেষ করে বড় অফিসার হয়। তাকে যেন আমাদের মতো ইপিজেডে শ্রম দিতে না হয়। 

রতন-রেশমা দম্পতির মতো হাজার হাজার পরিবার উত্তরা ইপিজেডে চাকরি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। বেকারত্বের অভিশাপের অন্ধকার থেকে জীবনকে করেছেন আলেকিত। 

জলঢাকা উপজেলার শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের জাহাঙ্গীর আলম। কাজ করেন স্টার প্যাকেজিংয়ে। তার স্ত্রীও চাকরি করেন চশমা তৈরির প্রতিষ্ঠান মার্জেন বিডিতে। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দুজনেই উত্তরা ইপিজেডে চাকরি করছি। আমাদের সংসার অনেক ভালো চলছে। এখন কাজের জন্য ঢাকা যেতে হয় না। বাড়ির কাছেই আমাদের কর্মস্থল।

সংগলশী ইউনিয়নের বাবুরহাট এলাকার ব্যবসায়ী সামসুল ইসলামের স্ত্রী মোছা. নার্গিস বেগম।  কাজ করছেন দেশবন্ধু গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানে। তিনি বলেন, আমাদের বাড়ি থেকে আমরা দুইজন আমি এবং আমার ভাবি উত্তরা ইপিজেডে চাকরি করি। আমরা প্রতি মাসে যা বেতন পাই তা দিয়ে আমাদের সংসারে অনেক সাহায্য হয়। আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে তা অনেক সাহায্য করবে।

সংগলশী ইউনিয়ের দোলাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব সিরাজুল ইসলাম বলেন, ১৫ বছর আগেও সংগলশী ইউনিয়নের কাজীপাড়া, দোলাপাড়াসহ আশপাশের কয়েকটা গ্রামে টিনের বাড়িও খুঁজে পাওয়া যেত না। উত্তরা ইপিজেডে প্রায় সকল পরিবারেরই দুই-একজন করে চাকরি করে। সকলেই এখন অর্থিকভাবে সচ্ছল। অনেকেই পাকা বাড়ি বানিয়েছেন, টিনের বাড়ি করেছেন।

নীলফামারী সদর উপজেলার টেক্সটাইল এলাকার বাসিন্দা হেলেনা আক্তার। ১৪ মাস ধরে কাজ করেন উত্তরা ইপিজেডে। তিনি বলেন, আমি যা বেতন পাই তাতে আমার সংসারে অনেক উপকার হয়। উত্তরা ইপিজেডে অনেক মেয়ে কাজ করে। তারাও আয় করছে। পরিবারে তাদের মূল্যায়ন বেড়েছে।

নীলফামারী সদর উপজেলার সংগলশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মেস্তাফিজার রহমান ঢাকা পোস্টকে জানান, নীলফামারীর সংগলশীতে উত্তরা ইপিজেড স্থাপন হওয়ায় এখানকার বেকার জনগোষ্ঠীর কাজের ব্যবস্থা হওয়ায় তাদের পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। পূর্বের তুলনায় তাদের চলাফেরা, পোশাক-পরিচ্ছদসহ জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে। সবমিলিয়ে উত্তরা ইপিজেডে চাকরি করে প্রায় প্রতিটি পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল। 

উত্তরা ইপিজেড শুধু নীলফামারী সদর নয়, এ জেলার ডালিয়া, ডোমার, জলঢাকা, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা, কাহারোল, বীরগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, ঝাড়বাড়ী এবং রংপুর ও কুড়িগ্রামের মানুষেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। বদলে গেছে এ অঞ্চলের অর্থনীতি।

নীলফামারী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এলিনা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, উত্তরা ইপিজেডের কারণে নীলফামারী উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে উদীয়মান একটি জেলা। দারিদ্র্যপীড়িত জেলা থেকে বের হয়ে আশা ১০ জেলার মধ্যে নীলফামারী অন্যতম। প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ উত্তরা ইপিজেডে কাজ করে। যার বেশিরভাগই মেয়ে। এখানকার মানুষেরা কর্মব্যস্ত বেশি। ফলে আমরা এই উপজেলাকে বাল্যবিবাহমুক্ত করতে পেরেছি, নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে, পারিবারিক কলহ কমেছে। সবদিক বিবেচনা করলে নীলফামারীর অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি উত্তরা ইপিজেড।

তিনি জানান, নীলফামারীতে একটি হাইটেক পার্ক স্থাপন প্রক্রিয়াধীন আছে। এটি স্থাপন হলে নীলফামারী শিক্ষিত তরুণ সমাজ সেখানে কাজের সুযোগ পাবে। এছাড়াও একটি ইকোনোমিক জোন প্রস্তুত করা হচ্ছে।

নীলফামারী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নীলফামারী পৌরসভার মেয়র দেওয়ান কামাল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর উত্তরাঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য উত্তরা ইপিজেড স্থাপন করেন। জেলার প্রত্যকে এলাকার মানুষ এখানে কাজ করে। আমরা এক সময় মঙ্গাপীড়িত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিলাম। এই অঞ্চলে আশ্বিন-কার্তিক মাস খুব কষ্টে কাটতো মানুষদের। 

তিনি আরও জানান, কচু-ঘেচু খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করত মানুষ। অনেকেই ডায়রিয়ায় মারা যেত। ইপিজেড স্থাপন হওয়ার কারণে এখন আর সেই অবস্থা নেই। আগে এখানে ঝুপড়ি ঘর বা ছাউনি ঘর দেখা যেত। এখন আর দেখা যায় না। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে। নীলফামারীর মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হয়েছে। 

উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা দূরীকরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নীলফামারীর সোনারায় ইউনিয়নে ২১২ একর জায়গায় উত্তরা ইপিজেড স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। ২০০১ সালের ১ জুলাই তিনি নীলফামারী এসে উত্তরা ইপিজেডের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ওই সময় চীনের একটি মাত্র সোয়েটার কোম্পানি দিয়ে উত্তরা ইউপিজেডের পথচলা শুরু হয়েছিল।

অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যখন এখানে এসে কারখানা স্থাপনের পথ খুঁজছিল তখনি সরকারের পট পরিবর্তন হয়। ২০০১ সালে ১০ অক্টোবর বিএনপি ক্ষমতায় এলে উত্তরা ইপিজেডকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। অনেক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পেরিয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে নতুনরূপে উত্তরা ইপিজেড প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরে পেতে শুরু করে।

বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বেড়ে এটি এখন বৃহৎ ইপিজেডে পরিণত হয়েছে। তার ওপর পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহ নিয়ে আসার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। গ্যাস এলে উত্তরা ইপিজেড হয়ে উঠবে আরও প্রাণবন্ত।

বর্তমানে উত্তরা ইপিজেডে ২৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৩৫ হাজার শ্রমিকের মধ্যে ১৫ হাজার দক্ষ শ্রমিক রফতানিমুখী পণ্য উৎপাদনে কাজ করছেন। এখানে উৎপাদিত পরচুলা, খেলনা গাড়ি, চশমা, কফিন, লেদার ব্যাগ, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন রকমারি পণ্য  ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে।

উত্তরা ইপিজেড প্রতি মাসে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। এর রফতানির পরিমাণ এক হাজার ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখানে কর্মরত শ্রমিকরা প্রতি মাসে ৪০ কোটি টাকা আয় করেন। উত্তরা ইপিজেডের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ মঙ্গাপীড়িত এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। দূর করেছে বেকারত্বের অভিশাপ।

আরএআর