পুলিশের গাড়ি দেখলেই দোকান বন্ধ
পাড়া-মহল্লার রাস্তাগুলোতে মানুষ অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে নওগাঁ পৌরসভা এলাকা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় সর্বাত্মক লকডাউন ও জেলার আরও তিনটি উপজেলায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের তৃতীয় দিন চলছে শনিবার (৫ জুন)। লকডাউনের আগের দুই দিনের তুলনায় রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল কিছুটা বেড়েছে। পুলিশ ও প্রশাসনের তৎপরতার কারণে নওগাঁ পৌর শহরের প্রধান সড়কগুলোতে যানবাহন ও মানুষের চলাচল কম দেখা গেলেও পাড়া-মহল্লার রাস্তাগুলোতে মানুষ অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
শনিবার নওগাঁ শহর বিভিন্ন এলাকা ও নিয়ামতপুর উপজেলার ছাতড়া বাজারে এসব দৃশ্য দেখা যায়।
বিজ্ঞাপন
এদিকে কয়েক দিন ধরে জেলায় করোনা সংক্রমণের হার কিছুটা নিম্নমুখী লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে এখনো করোনা সংক্রমণের হার রয়েছে, তা উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
দুপুরে নওগাঁ শহরের উকিলপাড়া, হাট-নওগাঁ, চকদেবপাড়া ও পার-নওগাঁ ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তায় রিকশা, অটোরিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন ও মানুষের চলাচল বেড়েছে। এসব মহল্লার অধিকাংশ দোকানপাট খোলা থাকতে দেখা যায়। তবে শহরের মূল রাস্তাগুলোয় মোড়ে মোড়ে পুলিশের তল্লাশিচৌকি থাকায় চলাচল কম দেখা গেছে। এসব তল্লাশিচৌকিতে যানবাহনের চালক ও যাত্রীদের পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হয়েছে। জরুরি কাজে বের হওয়া যথার্থ প্রমাণ দিয়ে ছাড় পেতে হয়।
বিকেল চারটার দিকে শহরের বিহারি কলোনি এলাকায় পুলিশের গাড়ি আসতে দেখে খুলে রাখা দোকানপাট ও চায়ের দোকানগুলো তাড়াহুড়ো করে বন্ধ করতে দেখা যায়।
বিজ্ঞাপন
শুধু বিহারি কলোনি এলাকাতেই পুলিশের গাড়ি চলে গেলে দোকানপাট খুলে দেওয়া। আবার পুলিশের গাড়ি আসার খবর পেয়ে দোকানের শাটার বন্ধ করা শহরের সব পাড়া-মহল্লা ও গ্রামের হাট-বাজারগুলোয় ঘটছে। অধিকাংশ সময় মানুষের মাস্ক থুতনি ও পকেটে রাখতে গেলেও পুলিশ ও কিংবা ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট দেখে মাস্ক উঠে আসছে মুখে।
শহরের বিহারি কলোনি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করেই চলছে বাজারঘাট। অধিকাংশ ক্রেতা-বিক্রেতার মুখেই ছিল না মাস্ক। দুই-একজন ছাড়া অধিকাংশ মানুষের মাস্ক থুতনিতে কিংবা পকেটে রাখতে দেখা গেছে।
অনেকের মতোই মুখে মাস্ক না পরেই সবজি বিক্রি করছিলেন কামাল হোসেন। মাস্ক পরেননি কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাস্ক পরে কী হবে, স্যার? মাস্ক পরে কি মৃত্যু ঠ্যাকানো যাবে? আল্লাহ যখন মৃত্যু লেখে র্যাখবে, তখন মৃত্যু হবেই। কেউই ঠ্যাকাতে প্যারবে না। মাস্ক পরলে করোনা হবে না, এটা মোর বিশ্বাস হয় না।
বেলা ২টার দিকে নিয়ামতপুর উপজেলার ছাতড়া বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় স্বাভাবিক দিনের মতো অবস্থা। বাজারের ধানের হাটে লোকজনের অনেক উপস্থিতি ছিল। অধিকাংশ মানুষের মুখে নেই কোনো মাস্ক। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে একে অপরের গা ঘেঁষে চলাচল করছে। বাজারের রাস্তার ধারে ছোটখাটো দোকানপাট খোলা ছিল।
মানুষের মধ্যে এমন বেপরোয়া ভাব দেখে নওগাঁর ডেপুটি সিভিল সার্জন মঞ্জুর-এ মোর্শেদ বলেন, মানুষ সচেতন না হলে লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ যতই আরোপ করা হোক না কেন, তা কোনো কাজে আসবে না। মানুষের এমন উদাসীনতার কারণে আমাদের সবাইকে মূল্য দিতে হবে। বিধিনিষেধের আরোপের ফলে সাময়িক একটু কষ্ট হলেও অন্তত জীবনটা রক্ষা হবে, এই বোধ থেকে আমাদের সবাইকে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত।
করোনা সংক্রমণ সাম্যন্য কমেছে
গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় নতুন করে দুজনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনিবার সকালে নওগাঁ সদর হাসপাতালে অ্যান্টিজেন টেস্ট পরীক্ষায় ওই দুজনের করোনা শনাক্ত হয়। তারা দুজনই নওগাঁ পৌরসভার হাট-নওগাঁ এলাকার বাসিন্দা।
সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ২০ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪৯৫টি নমুনা পরীক্ষায় ১৫৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৩২ দশমিক ১২ শতাংশ। গত মঙ্গলবার (১ জুন) থেকে বৃহস্পতিবার (৩ জুন) পর্যন্ত তিন দিনে ১৭৯টি নমুনা পরীক্ষায় ৪৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।
নওগাঁয় প্রথম কোনো ব্যক্তির করোনা শনাক্ত হয় গত বছরের ১৩ মে। সেই থেকে শনিবার পর্যন্ত ১৫৬২৯ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২ হাজার ৩৬৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত জেলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৯১ শতাংশ।
এ ব্যাপারে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নওগাঁ সদর আধুনিক হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক এ বি এম আবু হানিফ বলেন, কয়েক দিন ধরে সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা নিম্নমুখী হলেও নওগাঁ এখনো খুব একটা স্বস্তিজনক অবস্থায় নেই। যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই কেবল এই সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ হতে পারে।
নওগাঁর কোনো হাসপাতালে আইসিইউ নেই
নওগাঁয় করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নওগাঁ সদর আধুনিক হাসপাতালের করোনা ইউনিটসহ সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) নেই। করোনা ইউনিটে কর্তব্যরত একাধিক চিকিৎসা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নওগাঁর কোনো হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা না থাকায় করোনায় আক্রান্ত জটিল রোগীদের রাজশাহী কিংবা বগুড়ার হাসপাতালে পাঠাতে হয়। কিন্তু রোগী পরিবহনে ব্যবহৃত এখানকার অ্যাম্বুলেন্সগুলোয় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা না থাকায় ওই সব জটিল রোগীকে রাজশাহী কিংবা বগুড়ার নিতে গিয়ে তাদের শারীরিক অবস্থা আরও জটিল হয়ে পড়ে। ফলে তাদের মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
নওগাঁ সদর হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন নওগাঁ শহরের চকদেবপাড়া এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম। শনিবার সকালে হাসপাতাল চত্বরে কথা হয় সাইফুল ইসলামের ছেলে সাব্বির রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাবাকে ১ জুন হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। গতকাল রাত থেকে বাবার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন দেওয়ার পরও শ্বাসকষ্ট কমছে না। চিকিৎসকেরা বলছেন, তাকে এখন আইসিইউ বেডে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। আইসিইউ বেডে নেওয়ার জন্য বাবাকে আজই রাজশাহী কিংবা বগুড়ায় নিতে হবে। নওগাঁর হাসপাতালে আইসিইউ-সুবিধা থাকলে এই ভোগান্তিটা পোহাতে হতো না।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চিকিৎসা কর্মকর্তা আশিষ কুমার সরকার বলেন, নওগাঁ সদর হাসপাতালসহ জেলার ১০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০১টি শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বর্তমানে ১২১ শয্যায় রোগী আছেন, আর ৮০টি শয্যা এখনো খালি রয়েছে। জেলার কোনো হাসপাতালেই আইসিইউ বেড নেই। নওগাঁ সদর হাসপাতাল, নিয়ামতপুর, পোরশা ও সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা রয়েছে। অন্য হাসপাতালগুলোতে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা নেই।
শামীনূর রহমান/এনএ