নিহত নাজনীন

বগুড়া সৈয়দ আহম্মেদ কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী নাজনীন হত্যায় ১০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। নিহত নাজনীনের স্বামী অভিযুক্ত ঘাতক ঝাড়ুদার সাকিব, তার বাবা ভ্যান চালক আব্দুল করিম, মা বিথি বেগম, বোন রাশিদা বেগমের নাম উল্লেখ করে ও ৬ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে শুক্রবার (৪ জুন) রাতে বগুড়া সদর থানায় মামলাটি দায়ের করেন নিহত নাজনীনের পিতা ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ। 

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তদন্তকারী পুলিশ উপ-পরিদর্শক (এসআই) গোলাম মোস্তফা। তিনি জানিয়েছেন, শুক্রবার বগুড়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মমিন হাসানের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে মামলার প্রধান আসামি সাকিব হাওলাদার।

দ্রুত সময়ের মধ্যে হত্যার রহস্য উদঘাটন নিয়ে পুলিশ বলছে, প্রথমে কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না। ঘাতক সাকিব হত্যার কথা স্বীকার করলেও লাশ না পাওয়ায় মামলাটি ‌‘‌এভিডেন্টিয়াল ফলস্' হয়ে যাচ্ছিল। আদালতে গ্রেফতার আসামি স্বীকারোক্তি নাও দিতে পারত। এ নিয়ে পুলিশ দ্বিধায় পড়ে যায়। ঘাতক যেখানে লাশ ফেলেছে সেখানে ওড়না, নখ আর চামড়া পাওয়া যায়। তাহলে কি লাশ পুড়িয়ে দিয়েছে? লাশ পুড়িয়ে দিলে মামলার ধরন বদলে যাবে। এছাড়া ঘাতক সাকিব স্বীকার করেছে, হত্যায় সে একা ছিল। কিন্তু ঘটনাস্থলের ‘‌ক্রাইম সিন’ বলছিল ভিন্ন কথা।

তদন্তে জড়িত গৌরনদী থানার এক কর্মকর্তা জানান, সাকিব ছাড়া আর কোনো ব্যক্তি পাওয়া যাচ্ছিল না যাদের সূত্র ধরে হত্যা রহস্যের শেষ পর্যন্ত যাওয়া যাবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে ক্লু উদঘাটন করা না গেলে মামলাটি অনিশ্চয়তায় পড়ে যেত। এজন্য সাকিবের বাবা আব্দুল করিম বাটাজোর বন্দরে যে মুদি দোকানে খোশ-গল্প বেশি করত তাকে টার্গেট করে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। শুরুতে পুলিশ ধরে নিয়েছিল, আড্ডা দেওয়ার দোকানদারকে দিয়ে ক্লু উদঘাটন হবে না। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে ৩৫ বছর বয়সী ওই ব্যবসায়ীকে নিয়ে থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। হত্যায় সেই ব্যবসায়ীর সম্পৃক্ততা না থাকলেও পুরো ঘটনার তথ্য ওই ব্যবসায়ীর মাধ্যমেই পেয়ে যায় পুলিশ। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লাশের সন্ধ্যান দেন সেই ব্যবসায়ী। জানা গেছে, হত্যার ঘটনাটি জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর করিম সপরিবারে এলাকা ছাড়েন। এছাড়া করিম গল্পচ্ছলে লাশ গুমের কথাও জানিয়েছিল বলে জানান ওই মুদি ব্যবসায়ী।

তদন্ত কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, মামলার প্রধান আসামি সাকিব ছাড়া বাকিরা পলাতক। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, হত্যার পর পরিবারের মধ্যে জানাজানি হলে সাকিবের বাবা, মা ও বোন সেফটিক ট্যাংকির ভেতর থেকে লাশ তুলে প্রথমে পলিথিন পেঁচিয়ে চিনির বস্তায় ঢুকায় নাজনীনের লাশ। পরে আরেকটি বস্তায় ভরে সাকিবের বাবা করিম হাওলাদার ভ্যানে করে লাশটি নিয়ে বাটাজোর কাটাগাছতলা নামক এলাকার খালের ওপারে ধানখেতে ফেলে আসে।

নিহত কলেজছাত্রী নাজনীন আক্তার বগুড়া সদর থানার সাপগ্রামের আব্দুল লতিফের মেয়ে ও স্থানীয় সৈয়দ আহম্মেদ কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। ফেসবুকের মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিচয় হয় বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার নতুনচর জাহাপুর গ্রামের আব্দুল করিম হাওলাদারের ছেলে সাকিব হোসেন হাওলাদারের। সাকিব হোসেন বগুড়ার জাহাঙ্গীরাবাদ সেনানিবাসে ঝাড়ুদার হিসেবে কর্মরত।

২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সাকিব ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে কলেজছাত্রী নাজনীনকে বিয়ে করেন। গত ২৪ মে সাকিব তার বাবা অসুস্থ বলে নাজনীনকে নিয়ে বরিশালে যান।

সাকিব বলেন, রাত ৯টার দিকে গৌরনদীর বাটাজোর ইউনিয়নের হরহর গ্রামে বাবার ভাড়াটিয়া সালাউদ্দিনের বাড়িতে আমরা আসি। এ সময় আমার বাবা-মা কেউ বাসায় ছিল না। নানার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল সবাই। আমার স্ত্রী নাজনীন আমাদের কাঁচাঘর ও টয়লেট দেখে আমার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে। টয়লেটে টিনের বেড়া দেখে আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এতে আমি ক্ষিপ্ত হয়ে ঘরের বাইরে থাকা প্লাস্টিকের রশি দিয়ে তার গলায় ফাঁস ও বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করি। পরে পাশের সেপটিক ট্যাংকে মরদেহ গুম করি। আমার শ্বশুর আব্দুল লতিফ প্রমাণিক ২৬ মে আমার ইউনিটে ও থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইউনিট ইনচার্জ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আমি খুন ও মরদেহ গুমের কথা স্বীকার করি।

এদিকে সাকিবের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তাকে নিয়ে মঙ্গলবার (১ জুন) গৌরনদী মডেল থানা পুলিশের সহায়তা বগুড়া সদর থানা পুলিশ তাদের বাড়ির সেপটিক ট্যাংকে পাম্প দিয়ে পানি নিষ্কাশন করে। ট্যাংক থেকে মরদেহের বিভিন্ন অংশ, চামড়া, দুটি নখ এবং নাজনীনের ওড়না পাওয়া যায়। মরদেহ পাওয়া না যাওয়ায় আসামিকে নিয়ে বগুড়া ফিরে যায় পুলিশ। পরদিন বুধবার (২ জুন) গৌরনদীর হরহর গ্রামের একটি ধানখেতে নাজনীনের মরদেহ পায় পুলিশ। বৃহস্পতিবার ময়নাতদন্ত শেষে লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হয় নিহত নাজনীনের বড় ভাই আহাদ প্রমাণিকের কাছে। শুক্রবার নাজনীনের বাড়িতে দাফন হয়। রাতে বগুড়া সদর থানায় মামলা দায়ের করেন নিহতের পিতা আব্দুল লতিফ।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এসএসএইচ