ইসরাত জাহান তুষ্টি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান তুষ্টি বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হবে- এমন স্বপ্ন ছিল তার পরিবারের সদস্যদের। আর এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে তুষ্টি দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিচ্ছিল। 

যে কারণে তিনি করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার পরও ঢাকার আজিমপুর এলাকার সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারের একটি বাসায় থেকে পড়াশোনা অব্যাহত রেখে আসছিল বলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

কিন্তু সে স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন হল না নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার সুখারী ইউনিয়নের নীলকণ্ঠপুর গ্রামের বাসিন্দা ধান ব্যবসায়ী আলতাফ উদ্দিনের পরিবারের। স্বপ্নপূরণের আগেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান তুষ্টি।

মধ্যবিত্ত আলতাফ উদ্দিনের ৪ সন্তানের মধ্যে একমাত্র আদরের মেয়ে ছিল ইসরাত জাহান তুষ্টি। অন্য ৩ ছেলের মধ্যে বড় ছেলে সৌদিআরব প্রবাসী। আলতাফ উদ্দিনের সন্তানদের মধ্যে তুষ্টি ছিল দ্বিতীয়। তৃতীয়সন্তান ছেলে তুর্য এবার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র এবং চতুর্থ ছেলের বয়স ৬ বছর।

এ অবস্থায় শত অভাব-অনটনের মধ্যেও তুষ্টিকে ম্যাজিস্ট্রেট বানানোর স্বপ্ন বুনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন পরিবারটির প্রধান আলতাফ উদ্দিন। পরিবারের এ স্বপ্নপূরণে তুষ্টিরও চেষ্টার কমতি ছিল না কোনো। সে তার পরিবারের অক্ষমতাগুলো বুঝতো।

আলতাফ উদ্দিন বলেন, ‘তুষ্টি আমার সংসারের একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিল। সে নিজ তাগিদেই সব সময় লেখাপড়া করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। কোনো সময় সে মুখ কালো করে আমাদের সঙ্গে কথা বলেনি। অল্পতেই সে সন্তুষ্ট থাকত। সে আমার সব অভাব বুঝতো। সংসারের অভাব-অনটন দেখে সে বলতো ‘আমি বিসিএস পাস করে ম্যাজিস্ট্রেট হলে আমাদের সংসারে আর কোনো অভাব থাকবে না।’

তুষ্টির মাধ্যমিক বিদ্যালয় ধর্মরায় রামধন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সৈয়দ মোস্তফা রাশেদ কামাল বলেন, সাধারণ ঘরে জন্ম হলেও ছোটবেলা থেকেই তুষ্টি খুব মেধাবী ছিল। আমি তাকে পড়িয়েছি। আমাদের স্কুল থেকে চলে যাওয়ার পরও পড়াশোনা নিয়ে আমার সঙ্গে সে নিয়মিত যোগাযোগ করত। 

তিনি বলেন, স্থানীয় ধর্মরায় রামধন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সে পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করে। তারপর সে আমাদের বিদ্যালয় থেকে জেএসসি ও ২০১৬ সালে জিপিএ ৪.৯৮ পেয়ে এসএসসি পাস করে। সে ছিল আমাদের বিদ্যালয়ের ২০১৬ এসএসসি ব্যাচের সেরা শিক্ষার্থী।

তিনি আরও বলেন, কিন্তু পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পাওয়ায় তখন তুষ্টি খুবই কষ্ট পেয়েছিল। আমরা তাকে উৎসাহ যুগিয়েছি তখন। এরপর পার্শ্ববর্তী মদন উপজেলার জোবাইদা রহমান মহিলা কলেজ থেকে জিপিএ ৪.৬৭ পেয়ে এইচএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে।

তুষ্টির চাচা প্রভাষক ইমাম হোসেন মেহেদী বলেন, ছোটবেলা থেকেই তুষ্টির পড়াশোনার সবকিছু আমিই দেখভাল করে আসছিলাম। সংসারের শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সে সফলতার শীর্ষে পৌঁছার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। তুষ্টি যে কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনা করেছে আমি সেই কলেজেরই প্রভাষক। তার স্বপ্ন ছিল সে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে একজন ম্যাজিস্ট্রেট হবে। আমাদের একই স্বপ্ন ছিল।

তুষ্টির মাধ্যমিক বিদ্যালয় ধর্মরায় রামধন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রমজান আলী মির্জা বলেন, তুষ্টি খুবই নম্র, ভদ্র প্রকৃতির মেয়ে ছিল। সে আমার বিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ও আর্দশ শিক্ষার্থী হিসেবে সবার কাছেই প্রিয় ছিল। উত্তম চরিত্রের অধিকারী তুষ্টিকে নিয়ে আমাদের বিদ্যালয় নয়, শুধু সমস্ত এলাকাবাসীর স্বপ্ন ছিল।

স্থানীয় সুখারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন খোকন তালুকদার বলেন, মেয়েটিকে নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতাম। অনেক গর্ব করতাম। কিন্তু সেই স্বপ্ন ও গর্ব পুরোপুরি বাস্তবায়নের পূর্বেই শেষ হয়ে গেল। তুষ্টির পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমাদের নেই।

উল্লেখ্য, করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে ইসরাত জাহান তুষ্টি অন্য কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে ঢাকার আজিমপুর এলাকার সরকারি কোয়ার্টারের একটি বাসায় থেকে পড়াশোনা চালিয়ে আসছিল। 

শনিবার (৫ জুন) মধ্যরাতে তার এক রুমমেট তুষ্টিকে ওই বাসার বাথরুমে পড়ে থাকতে দেখে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করলে রোববার সকালে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বাথরুম থেকে শিক্ষার্থী তুষ্টির মৃতদেহ উদ্ধার করে। পরে মৃতদেহটি ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

মো. জিয়াউর রহমান/এমএসআর