‘একান ব্রিজ না হওয়াতে হামার কষ্টের শেষ নাই। ব্রিজ চাইতে চাইতে বাপ-দাদারা মরি গেইছে, তাও  কোনো ব্যবস্থা করে নাই। নির্বাচন আসলে নেতারা কয়, তোমার নদীটা তো বড় সমস্যা। ভোট দেও, এবার ব্রিজ হয়া যাইবে। হামরাও তাতে মাতি ভোট দেই। কিন্তু ব্রিজ আর হয় না।’ 

নদী পারাপারের জন্য দীর্ঘ ৫০ বছরেও কাঙ্ক্ষিত সেতু নির্মাণ না হওয়ায় এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ক্ষুব্ধ কৃষক পলাশ বাবু। তিনি থাকেন জয়বাংলা গ্রামে। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে জয়বাংলা গ্রাম। সেখানকার যমুনেশ্বরী নদীর চাকলাঘাটে সেতু না থাকায় পলাশ বাবুর মত প্রতিদিন দুর্ভোগের শিকার হন হাজারো মানুষ। সেতুর অভাবে জয়বাংলা গ্রামের মত অন্তত ১৫ গ্রামের মানুষ উন্নত যোগাযোগ সুবিধা থেকে পিছিয়ে রয়েছে।

শুষ্ক মৌসুমে বাঁশের তৈরি সাঁকো দিয়ে পারাপার হলেও বর্ষায় এসব গ্রামের হাজার হাজার মানুষ হয়ে পড়েন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। নৌকা দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পারাপারে প্রতি বছর ঘটছে দুর্ঘটনা। তারাগঞ্জ উপজেলা সদরের কুর্শা ইউনিয়নের চাকলা গ্রামে যমুনেশ্বরী নদীর ওই খেয়াঘাট অবস্থিত। 

খেয়াঘাটের চারপাশে জয়বাংলা, কবিরাজপাড়া, খিয়ারপাড়া, হাজিপাড়া, কুঠিপাড়া, জুম্মাপাড়া, সরকারপাড়া, চাকলা, জলুবার, বানয়িপাড়া, জেলেপাড়া, নদীর পার, পাচানীসহ ১৫টি গ্রাম। এই ঘাটে সেতু না থাকায় এসব গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ অতিকষ্টে প্রতিদিন যাতায়াত করেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর ওপর সেতু না থাকায় অসুস্থ নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, দিনমজুর, কৃষক, শ্রমিক, রিকশা-ভ্যানের চালকসহ মোটরসাইকেল চালকদের ভোগান্তির শেষ নেই। বর্তমানে স্থানীয়রা নদীর বুকে কাঠ ও বাঁশ দিয়ে একটি সাঁকো তৈরি করেছেন। ১৫ গ্রামের সবাই এই সাঁকো ব্যবহার করছেন। কিন্তু কোনো ধরনের ভারি যানবাহন এই সাঁকোর ওপর দিয়ে চলাচল করতে পারছে না। 

স্থানীয়রা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে বাঁশের সাঁকো দিয়ে পারাপার হলেও বর্ষাকালে বাড়ে ভোগান্তি। অনেক সময় সাঁকো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়। তখন নদী পারাপারে নৌকাই একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে। বর্ষা ও বন্যার সময় নৌকা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল করতে গিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটে।

রহিমাপুর চাকলা খেয়াঘাটের প্রবীণ মাঝি আবজারুল ইসলাম (৫৫) ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকার কত কিছু করে, খালি হামার গ্রামের কাছত পুল কোনা বানের না পারে। এটে একনা পুলের জন্য হামার কষ্ট চিরকাল।’ 
একই গ্রামের কালু মিয়া (৩১) বলেন, ‘বাহে হামার বাপ-দাদারাও এই নদীর জন্যে কষ্ট প্যায়া মরি গেইছে। হামরাও যাবার পথে, তবু এটেকোনা পুল হয়ছে না।’ 

বানিয়াপাড়া গ্রামের বৃদ্ধ বিধান রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন,‘নদীতে সেতু না থাকায় ধান, পাট, চাল, শাকসবজি শহরে নিয়া বিক্রি করা মুশকিল। বাধ্য হয়ে কম দামত জিনিসপত্র বেচতে হয়।’ 

ঘাড়ে বাইসাইকেল নিয়ে সাঁকো পার হওয়ার সময়ে কথা হয় নদীরপাড় গ্রামের কাইয়ুম হকের সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যদি রাইতোত কায়ও বাড়িত মরিও যায়, তাও রোগী মেডিকেলত নিয়া যাওয়া মুশকিল। হামার কপাল খারাপ। কায়ো এই গবিবের জনতে চিন্তা করে না।’

রহিমাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামলী রানী বলেন, চাকলাঘাটে সেতু না থাকায় বর্ষাকালে নদীর ওপারের পাচানী, জলুবার, নারায়ণজন গ্রামের বেশির ভাগ শিশু ভয়ে স্কুলে আসতে চায় না।

দুর্ভোগ আর ভোগান্তির কথা স্বীকার করে ঘাট এলাকার বাসিন্দা কুর্শা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তুহিনুর ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্তত পনেরো গ্রামের ২০ হাজার মানুষ এই নদীর ওপর দিয়ে যাতায়াত করে। আমরা চাকলাঘাটে একটা সেতু নির্মাণের জন্য বারবার দাবি জানিয়ে আসছি। দুঃখজনক আজও সেখানে একটা সেতু নির্মাণ হয়নি। এখন সেতু নিয়ে কথা বলতে লজ্জা লাগে।

কুর্শা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আফজালুল হক বলেন, যমুনেশ্বরী নদীর চাকলাঘাটে সেতু নির্মিত হলে অবহেলিত এই এলাকায় পরিবর্তন আসবে। মানুষের আয় উন্নতি বাড়ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের যাওয়া আসাও বাড়বে। এই সেতু নির্মাণ হলে হাজার হাজার মানুষ উপকৃত হবে। 

এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) তারাগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী আহাম্মেদ হায়দার বলেন, শিগগিরই খোঁজ নিয়ে ওই স্থানে সেতু নির্মাণের জন্য বরাদ্দ চেয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঢাকায় পাঠানো হবে। অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেলে সেতু নির্মাণ করে দেওয়া হবে। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর