মুন্সীগঞ্জের তিনটি উপজেলা- লৌহজং, টঙ্গিবাড়ী ও সদর পদ্মা নদীর ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লৌহজং উপজেলা। বর্ষার শুরুতেই এই উপজেলায় ভাঙন দেখা দিলে কোথাও কোথাও জিও ব্যাগ ফেলে তা ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়।

তবে গত এক সপ্তাহ ধরে পদ্মার প্রবল স্রোতের কারণে গাঁওদিয়া ইউনিয়নের হাড়িদিয়া পশ্চিমপাড়া শিমুলবাড়ি এলাকায় বহু জমি নদীতে ধসে গেছে। শতাধিক বসতঘর ও একটি মসজিদ ভাঙনের মুখে। আতঙ্কে দুই শতাধিক পরিবার নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে, অনেকে ইতোমধ্যে নিরাপদ স্থানে সরে গেছেন। প্রতিবছরই আড়াই লাখ জনসংখ্যার এই উপজেলার মানচিত্রে আঘাত হানছে ভয়াল পদ্মা।

টঙ্গিবাড়ী উপজেলার কান্দাবাড়ি, সরিষাবন, দিঘিরপাড় এবং সদর উপজেলার শম্ভুকান্দি, শিলই এলাকাতেও নদী ভাঙন চলছে।

লৌহজং উপজেলার স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক বছর ধরে হাড়িদিয়া ও গাঁওদিয়া গ্রামে পদ্মার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এই এলাকায় এখনো কোনো স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ হয়নি, ফলে গত দুই বছরে শতাধিক বসতঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে এবং প্রায় ২০০ পরিবার অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। বর্ষায় ভাঙন শুরু হলে জিও ব্যাগ ফেলা হয়, কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই আবার ভাঙন শুরু হয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, হাড়িদিয়া পশ্চিমপাড়ার আল-মদিনা জামে মসজিদের অজুখানায় বড় ফাটল ধরেছে, মসজিদের ভেতরেও ফাটল দেখা দিয়েছে। নদীর তীব্র স্রোত ও ঘূর্ণিপাকে নদীর তলদেশ ধসে গিয়ে চারপাশে ভাঙন বেড়েই চলেছে। স্থানীয়রা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে ব্যস্ত।

স্থানীয় বাসিন্দা ইসমাইল জানান, আমরা একশোটা খাম্বা দিয়ে বাঁধ দিয়েছিলাম, কিন্তু গত দুদিনেই সব ভেসে গেছে। এখন কেবল ২০টা খাম্বা আছে। আরেকজন বাসিন্দা নিজাম মাদবর বলেন, ২৫ বছর আগে ভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে এখানে নতুন করে বসতি গড়েছি। এখন আবার নদী ভাঙছে, এই বাড়িও হয়তো থাকবে না।

হাড়িদিয়া গ্রামের সেলিম মল্লিক বলেন, আল-মদিনা জামে মসজিদের দুই পাশই ভেঙে যাচ্ছে। দুদিন আগে ইউএনও মহোদয়কে জানিয়েছি, তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে কথা বলার আশ্বাস দিয়েছেন। স্থানীয় মুসল্লি জলিল চকিদার, দানেশ মাদবরসহ অনেকে বলেন, মসজিদটি ভেঙে গেলে নামাজ পড়া খুব কষ্টকর হয়ে যাবে। গত এক সপ্তাহের ভাঙনে এখানে ৪০-৫০ হাত গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বাঁধ নির্মাণের কাজ অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে। বর্ষা এলেই কিছু জিও ব্যাগ ফেলা হয়, কিন্তু বর্ষা শেষে কার্যকর কোনো অগ্রগতি দেখা যায় না। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে এই ভাঙন সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। গাঁওদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান টিটু শিকদার বলেন, দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পদ্মার পাড়ের অসংখ্য পরিবার বসতভিটা হারাবে। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নেছার উদ্দিন বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অন্যদিকে, সদর উপজেলার শম্ভুকান্দি এলাকায় পদ্মার ঘূর্ণিপাক স্রোতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এলাকাবাসী। ওই গ্রামের চায়না মল্লিক, রেখা মল্লিক, মলিন রায়সহ ১০-১৫টি হিন্দু পরিবার এখন প্রায় নিরুপায়। সামনে দুর্গাপূজা থাকলেও নদীভাঙনের কারণে কারো মধ্যেই উৎসবের আমেজ নেই।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গত এক মাস ধরে নদীতে সৃষ্ট প্রবল স্রোতের কারণে এলাকাটি নতুন করে ভাঙনের মুখে পড়েছে। ইতিমধ্যে ১০-১৫টি বসতঘর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভাঙছে মহেশপুর ও সরদারকান্দি এলাকাও। পাশের এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলা হলেও তা যথেষ্ট নয়, আর শম্ভু হালদার কান্দির বাসিন্দারা এই উদ্যোগের আওতায় আসেননি। ফলে ভিটেমাটি ভেঙে নদী লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে।

নদী ভাঙনের শিকার রেখা মল্লিক বলেন, দ্যাখেন, কই যামু? কয়ডা ব্যাগ ফেলানোর ব্যবস্থা করে দেন। কিসের পূজার আনন্দ, ঘরটা বাঁচবে কি না, তাই নিয়েই চিন্তায় আছি। সারারাত আমার স্বামী হাটে থাকে, কখন ভিটা ভেঙে নদীতে পড়ে যায় সেই আতঙ্কে থাকি।

স্থানীয় মলিন রায় বলেন, আমরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারপরও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সব নদীতে ভেসে যাওয়ার পর যদি তারা আসে তাহলে লাভ কী? কয়দিন পর দুর্গাপূজা, কিন্তু এখানকার কারো মধ্যে কোনো আনন্দ নেই।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, ভাঙনকবলিত স্থানে আমাদের কাজ চলছে। তবে পানি বাড়ায় আপাতত ড্রাম্পিং করা সম্ভব হচ্ছে না। পানি কমার সাথে সাথেই আবার ড্রাম্পিং শুরু করবো।

ব.ম শামীম/এআরবি